দোহারে নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় নিহত ৫
পাঁচ বছরই মুখোমুখি ছিল এমপির ভাই ও ইউপি চেয়ারম্যান
আহমদুল হাসান আসিক, দ্য রিপোর্ট : মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরই দোহারে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান খানের ভাই মোতালেব খান ও বিলাশপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন মোল্লা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দিন ৬ জানুয়ারি দোহার উপজেলার বিলাশপুর ইউনিয়নের হাজারবিঘা গ্রামে মুখোমুখি অবস্থানের নৃশংস রূপ দেখল দেশবাসী। এ সহিংসতার পর এখনও পুরো গ্রামে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নির্বাচনের পর দুই পক্ষের মধ্যে ক্ষমতা দখল, ক্ষমতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা এবং পূর্বশত্রুতার জের ধরেই এ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিলাশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মোল্লা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। দল পাঁচ বছর ক্ষমতায় আছে এবং নিজে একজন জনপ্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও এলাকার টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে জমি দখল, বালি ব্যবসা, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজি সব কিছুই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান খানের ভাই মোতালেব খান। মোতালেব খানের এ সব কাজে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে চকদার পরিবার কাজ করত। আর এ সব কাজের নেতৃত্ব দিয়েছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা বাশার চকদার ও হুকুম চকদার। স্থানীয়রা জানান, মোতালেবের মদদে বাশার এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করত।
এ সব বিষয় কেন্দ্র করে মোল্লা পরিবারের এবং চকদার পরিবারের বিরোধ দীর্ঘদিন ধরেই। আলাউদ্দিন মোল্লা ৫ বছরে কোনো কিছুর নিয়ন্ত্রণ নিতে না পেরে এবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী সালমা ইসলামকে সমর্থন করে। সালমা ইসলামের জয়ের পর বিজয় মিছিল করেন তার সমর্থকরা। আব্দুল মান্নানের ভাই মোতালেব খান এতে ক্ষিপ্ত হন।
স্থানীয়রা আরও জানান, নির্বাচনে মান্নান খান হেরে গেলে পাঁচ বছর ধরে এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য খর্ব হওয়ার আশঙ্কা থেকে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে চকদার পরিবার। এ ছাড়া মোতালেবের ইশারা এখানে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন বিষয় কেন্দ্র করেই সোমবার সকালে দুই পক্ষের কর্মীদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এরপর দুই পক্ষই লাঠিসোটা নিয়ে মারামারি করে। এ সময় ৭-৮ জন আহত হয়।
এর কিছুক্ষণ পর চকদার পরিবারের বাশার ও হুকুমের নেতৃত্বে ১৫০-১৬০ জন লোক আলাউদ্দিন মোল্লার সমর্থকদের বাড়িতে হামলা করে। এতে ৫ জন নিহত হন এবং আহত হন ২০ জন।
নিহতরা হলেন, মুসা খন্দকার (৫৫), ছেলে মাসুদ খন্দকার (২৮), ভাগ্নে রেজাউল (২৬)। এ ছাড়া অন্য দুইজন হলেন মকবুল হোসেন (৩৫) ও আসলাম হোসেন (২০)।
নিহতদের পরিবার ও পুলিশ মুখোমুখি
নিহত মকবুলের ভগ্নিপতি মো. আফতাব উদ্দিন বলেন, আব্দুল মান্নানের ভাই মোতালেব খানের নির্দেশে চকদার পরিবারের বাশার চকদার ও হুকুম চকদারের নেতৃত্বে সোমবার এ হামলা চালানো হয়। যারা হামলায় অংশ নেয় তারা হলো- ফরহাদ শেখ, আলমগীর শেখ, মালেক শেখ, রাসেল শেখ, লিয়াকত চকদার, রাশেদ চকদার, ওয়াদুদ চকদার, সেলিম চকদার, মন্নু শেখসহ আরও অন্তত ১৫০ জন। তারা আমাদের বাড়িতে এসে যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই কুপিয়েছে। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তারা হামলা চালায়। এখানে পুলিশের উপস্থিতি ছিল। দোহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম মিয়া উপস্থিত থেকেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বরং নীরব ভূমিকা পালন করেছেন।
নিহত মুসা খন্দকারের ছেলে জিয়া খন্দকার বলেন, পুলিশ প্রশাসন তাদের। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। আমাদের কাছ থেকে আগেই অস্ত্র সরিয়ে নিয়েছে। আমাদের নিরস্ত্র করে তাদের সুযোগ করে দিয়েছে। এর পরিণতিতে আমার বাবা ও ভাই খুন হয়েছেন। আমি এর বিচার চাই।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঘটনাস্থলে মাত্র ৩ জন পুলিশ ছিল। তারা ঘটনার সময় ৩ জনকে আটক করেছে। আর এটাকে প্রশাসন সাহসী ভূমিকা হিসেবেই দেখছে।
এ বিষয়ে অ্যাডিশনাল ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, পুলিশের ভূমিকা ছিল সেখানে খুবই সাহসী। তিনজন সদস্য থাকা সত্ত্বেও তারা সেখানে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ওসি কামরুল ইসলামকে দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি ব্যস্ত আছি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না।
এটা নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা নয়
পুলিশ এই সহিংসতাকে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা নয় বলে দাবি করেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও এটাকে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা নয় বলে দাবি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অ্যাডিশনাল ডিআইজি বলেন, তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব চলছে। নির্বাচনের পর সেটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা যাবে না।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, এটাকে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা বলা যাবে না। কেননা এটার সঙ্গে নির্বাচন নয় বরং পারিবারিক দ্বন্দ্বই জড়িত। আপনারা এটা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন।
ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দোহার উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, নির্বাচন নয়, পারিবারিক বিষয়টিই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। নির্বাচনে হেরে হয়ত ক্ষোভ বেড়েছে, তবে এটা কোনোভাবেই নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা নয়।
(দ্য রিপোর্ট/এএইচএ/এইচএসএম/শাহ/জানুয়ারি ৭, ২০১৪)