হরতাল-অবরোধ যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের। বাসা থেকে বের হতে কিছুটা ভয় বা আতঙ্ক থাকলেও চাকরি-বাকরি, জরুরি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে অনেকটা বাধ্য হয়েই রাস্তায় বের হচ্ছে মানুষ।

হরতাল-অবরোধে বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাকর্মীরা আগের মতো রাজপথে না নামায় মোটামুটি শান্ত রয়েছে পরিবেশ। যদিও মাঝে-মধ্যে ককটেল বিস্ফোরণ, ঝটিকা মিছিল বের হচ্ছে কোথাও কোথাও। তবুও মানুষের মধ্যে আগের চেয়ে আতঙ্ক একটু কমেছে।

সপ্তাহ দু’য়েক আগেও হরতাল-অবরোধে মানুষ রাস্তায় বের হতে অনেকটা চিন্তা-ভাবনা করতেন। আতঙ্কে থাকতেন বাসা থেকে বের হয়ে আবার জীবন নিয়ে বা অক্ষত অবস্থায় ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা। এখন এর অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। বিরোধী দলের টানা হরতাল-অবরোধ একসঙ্গে চললেও মানুষের যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে। জীবন জীবিকার তাগিদেই মানুষ বের হচ্ছেন রাস্তায়।

আগে বিরোধী দলের ডাকা হরতাল-অবরোধে দোকানপাট-মার্কেট বন্ধ থাকতো। রাস্তায় বাস বা গণপরিবহন চলাচল করতো অত্যন্ত সীমিতভাবে। জরুরি কাজে যারা রাস্তায় বের হতেন যানবাহন না পেয়ে বিপাকে পড়তেন। হেঁটেই গন্তব্যে যেতেন অনেকে। কিন্তু ইদানিং এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

সরেজমিনে মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টন, বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল, মৌচাক, গুলিস্তান, সদরঘাট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফুটপাথে জমে উঠেছে কমদামি শীতবস্ত্রের দোকান। বিরোধী দলের টানা অবরোধের পাশাপাশি হরতাল চলছে, কিন্তু এর প্রভাব কমই পড়েছে ফুটপাথে। ফুটপাথের দোকানে ভিড় করছেন মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষ। ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের গরম কাপড় বেচাকেনা জমে উঠেছে এসব কমদামি দোকানে।

পল্টনের ফুটপাথে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছেন মোবারক আলী। তিনি বলেন, ‘শীতের মওসুম শুরু হয়েছে অনেকদিন ধরে। এখন ব্যবসার সময়। ঘরে আর কয়দিন বসে থাকা যায়। বউ পোলাপান তো আছে তাই না? ব্যবসা-বাণিজ্য না করলে চলবো কেমনে। তাই মনে একটু ভয় থাকলেও দোকান খুলেছি। বেচাকেনা চলছে, খারাপ না।’

বায়তুল মোকাররমের সামনে ফুটপাথে গরম কাপড়ের দোকানদার রবিউল হোসেন বলেন,‘ভাই আর কয়দিন বন্ধ রাখমু, পেট তো চইলতে হবে। তবে ভয়ে থাকি, কখন বোমা পড়ে, পুলিশ গুলি চালায়। তখন তো আবার দোকান বন্ধ করার সময়ও পাই না। কোনোমতে কাপড়গুলো গোছায়ে দৌড় দিতে হয়।’

রবিউলের পাশের শীতবস্ত্রের আরেক দোকানি মানিক জানায়, ‘দোকান খুলেছি ঠিক, তবে ভয়ে থাকি কখন জানি কি ঘটে। এছাড়া পুলিশও মাঝে মধ্যে সমস্যা করে।’

পুলিশ কি সমস্যা করে- এমন প্রশ্নের উত্তরে মানিক জানায়, জানেনই তো ভাই সব কি আর বলা যায়…।

রাজধানীর তোপখানা রোডের মেহেরবা প্লাজার নিচে ফুজি কালার স্টুডিওর মালিক এসএম নূরুল ইসলাম। হরতাল-অবরোধে তার স্টুডিও বন্ধ থাকলেও গত কয়েকদিন ধরে খোলা রাখছেন। তিনি বলেন, গত ৩-৪ মাস ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য নাই। কমপক্ষে দোকান ভাড়া তো দিতে হবে। কয়দিন আর বন্ধ রাখব বলেন…।

গুলিস্তান গোলাপশাহ মাজারের সামনের মার্কেটের দোকানদার মো. রনি জানায়, এতদিন এক শাটার বন্ধ করে ব্যবসা করতাম। কয়েকদিন ধরে আর শাটার বন্ধ রাখি না। এখন শীতকাল, ব্যবসার ভরা মৌসুম। অথচ দুই দলের রেষারেষিতে ব্যবসা করতে পারছি না। সবাই ক্ষমতার পাগল। আর আমরা জনগণ যেন তাদের বলির পাঁঠা। এ অবস্থা আর কতদিন কে জানে।

সদরঘাট মোড় ফুটপাথে বাচ্চাদের শীতবস্ত্রের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা জাহাঙ্গীর জানান,‘ব্যবসা করছি বটে,কিন্তু আতঙ্কে থাকি বোমাটা আবার আমার ঘাড়েই পড়ে কিনা। এভাবে কি দেশ চলতে পারে...?

মতিঝিল দিলকুশা বিনিয়োগ বোর্ডের সামনে ফুটপাথের দোকানি নজরুল বলেন, ‘ভাই আমরা ক্ষমতা বুঝি না। আমরা দুই বেলা বউ পোলাপানরে নিয়ে পেট ভরে খেতে পারলেই হলো। আমাদের নিয়ে তাহলে এত টানাটানি কেন...? ভোট হলো, কিন্তু দিতে পারলাম না। ভোট ছাড়াই নাকি এমপি হইয়া গেছে তানসেন।’ তাও যদি দেশটা শান্তি হতো।

বেসরকারী একটি ব্যাংকে চাকরি করেন ফখরুল ইসলাম। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি বললেন, রাজনীতিবিদদের ওপর তার ক্ষোভের কথা। তিনি বলেন, নেতারা দেশটাকে শেষ করে দিল। কেউ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আর কেউ আকড়ে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে। আর আমরা শালা পাবলিক মরছি বোমা আর পুলিশের গুলিতে।

কথা হয় কয়েকজন রিকশাওয়ালা, সিএনজি চালকের সঙ্গেও। তারাও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন। সবার যেন আক্রোশ ওই রাজনীতিবিদদের ওপরই। তারা বলেন, আমরা রাজনীতি বুঝি না। ক্ষমতায় কে থাকল আর কে থাকল না এসব আমাদের জানার দরকার নেই। আমরা দেশে শান্তি চাই।

নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি-জামায়াত জোট। দাবি আদায়ে টানা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিও পালন করছে তারা। গত ৫ জানুয়ারি বিরোধীদলের অংশগ্রহণ ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয় ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদিও এ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচনের আগের দিন থেকেই টানা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতালের সময় বাড়িয়েছে ১৮ দল।


(দ্য রিপোর্ট/ কেএ/ এইচএসএম/ এনআই/ জানুয়ারি ০৭, ২০১৪)