তদন্ত করছে দুদক
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালকের অর্থ আত্মসাৎ
আমিরুল ইসলাম নয়ন, দ্য রিপোর্ট : বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ গ্রহণ ও নানা অনিয়মের মাধ্যমে শতাধিক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বেসরকারি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহীদুল আহসান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টের এক প্রতিবেদনে তার এই দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ প্রতিবেদনের সূত্র ধরে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দুদক আইনের ১৯ ও ২০ ধারা ও কমিশন বিধিমালার ২০ বিধিসহ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬০ ধারা অনুসারে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বলে দুদক সূত্র জানায়।
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ ও মাদামবিবির হাট শাখা পরিদর্শনকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুসন্ধানে এ অনিয়ম ধরা পড়ে।
এটাকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদামবিবির হাট শাখা ‘মেসার্স রিজেন্ট কর্পোরেশনে’র নামে ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গুলশান শাখার গ্রাহক ‘মেসার্স ফ্রেন্ডস ট্রের্ডাস’-এর অনুকূলে টিএসপি সার কেনার নামে ২ কোটি টাকা করে মোট ১০ কোটি টাকার ৫টি স্থানীয় ঋণপত্র খোলা হয়।
বিধি মোতাবেক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামানতের বিপরীতে ১০ শতাংশ মার্জিন রেখে সর্বোচ্চ ২ কোটি টাকার লোকাল এলসি খোলার অনুমোদন দিতে পারেন। কিন্তু রিজেন্টের ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয়নি।
এ ছাড়া আগ্রাবাদ শাখা থেকেই ‘মেশমার্ক লিমিটেড’ নামে আরেকটি শিপ ব্রেকার্স প্রতিষ্ঠানের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই ঋণ মঞ্জুর করান শহীদুল আহসান। মঞ্জুরকৃত ঋণের ওই অর্থ আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর ও পুনরায় স্থানান্তর করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনকালে ধরা পড়ে। এ খাতে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলা হয়েছে।
আগ্রাবাদ শাখার দুর্নীতি
মেসার্স তিতাস এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে ফান্ডেড ঋণ সুবিধার অনুমোদন বা মঞ্জুরি না থাকা সত্ত্বেও একই দিনে ৫টি প্যাড অ্যাকাউন্টে প্রায় ৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকার এলসিমূল্য পরিশোধ করা হয়। কিন্তু গুদামে ওই পরিমাণ মাল পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্লেখিত দুই কোম্পানির কাছে ব্যাংকের পাওনা অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
আগ্রাবাদ শাখার গ্রাহক ‘মেসার্স মিশম্যাক শিপ ব্রেকিং ইন্ড্রাস্ট্রি’র পক্ষে ডেফার্ড এলসিমূল্য ফোর্সড লোন পরিশোধের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। কিন্তু এলসির বিপরীতে জাহাজের মালামালের ওপর শাখার কোনো মনিটরিং নেই। ফলে বিক্রীত অর্থ আদায় হচ্ছে না। এতে ১২২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা সমন্বয়ের সম্ভাবনা খুবই কম।
অনুমোদনের আগেই প্রধান শাখার ক্রেডিট অ্যাডমিন বিভাগের ডেবিট ইন্সট্রাকশনের মাধ্যমে আগ্রাবাদ শাখার গ্রাহক মিশম্যাক শিপ ব্রেকিংয়ের অনুকূলে প্রেফার্মা ইনভয়েসের বিপরীতে ২০ কোটি টাকার টাইম লোন দেওয়া হয়, যা বর্তমানে ২১ কোটি ৮২ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। এটিও আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহক মেসার্স মিশম্যাক শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজের মালামাল না থাকায় ও মনিটরিং না থাকায় ১২২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং ২১ কোটি ৮২ লাখ টাকার মোট ১৪৪ কোটি ৪১ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
এদিকে দুদক সূত্র জানিয়েছে, দুটি প্রতিষ্ঠানই শহীদুল আহসানের বেনামি প্রতিষ্ঠান বলে অভিযোগ করেছেন ওই শাখা দুটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে তার প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা তার নাম ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন বলে দুদক কমিশনার শাহাবউদ্দিনের কাছে অভিযোগ করেন।
ওই অভিযোগে (চিঠি নং-১৫৬৩৪) বলা হয়েছে, ওই কর্মকর্তাকে না জানিয়ে ২০১১ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা মাসিক সম্মানীতে মাকের্টিং বিভাগে চাকরি দেন। কিন্তু ২০১৩ সাল পর্যন্ত তাকে কোনো সম্মানী দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তার নাম ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। তার ব্যাংক হিসাব থেকে ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর টাকা ও গ্যারান্টার না থাকা সত্ত্বেও ৫টি এলসি খোলেন। এতে তার কাছে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অনিয়ম শোনার পর শহীদুল আহসানের কাছে কাগজ চাইলে তিনি তা দেননি।
শহীদুল আহসান চায়না থেকে বিভিন্ন সময়ে ডিএপি এবং টিএসপি সার সরাসরি আমদানি করে চট্টগ্রামে তার নিজের গুদামে রাখতেন। আমদানিকৃত সারের উপর তিনি সরকারি ভর্তুকি নেন। ভর্তুকি সার ডিলার ব্যতীত বিক্রি নিষেধ কিন্তু তিনি খোলা বাজারে বিক্রি করেছেন।
ওই কর্মকর্তা চিঠিতে আরও উল্লেখ করেন, আমি শহীদুল সাহেবের কোম্পানিতে চাকরি করতাম। তার নির্দেশে ব্যাংক হিসাব খুলি এবং ট্রেড লাইসেন্স নেই। তার নির্দেশে সার আমদানি সংক্রান্ত কাগজ স্বাক্ষর করে ব্যাংকে জমা করি। কিন্তু শর্ত অনুসারে এলসির বিপরীতে কোন জামানত দেইনি। শহীদুল সাহেব ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে লোকাল এলসি খোলেন। এলসির ইনভয়েসিং অনুসারে আমদানিকৃত সার আমার গুদামে জমা করা হয়েছে এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যাক টু ব্যাক এলসির টাকা এসআইবিএলের গুলশান শাখায় প্রতারণামূলক জমা করা হয়।
এটা সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের চাপ দিয়ে করানো হয়েছে বলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ, তিনি (শহীদুল) পরিচালক এবং তাঁর বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে বেআইনিভাবে ঋণ দেওয়ার জন্য আমাদের দিয়ে জোর করে সই করিয়ে নেন। কিন্তু তিনি ওই সব ঋণের বিপরীতে কোনো অর্থ পরিশোধ না করায় ভবিষ্যতে আমরা বিপদে পড়তে পারি। এ ধরনের বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে তিনি প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানের জন্য শহীদুল আহসানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের খোঁজ নিচ্ছে দুদক।
তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, ঢাকার পুরানা পল্টনে ‘স্বদেশ টাওয়ার’টি শহীদুল আহসানের। এই ভবন তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কাছেই ভাড়া দিয়েছেন। তা-ও আবার বাজারদরের চেয়ে চার গুণ বেশি দামে। ভাড়া ও অগ্রিম বাবদ বিপুল অর্থও নেওয়া হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে। দুদক এ বিষয়ে পৃথকভাবে অনুসন্ধান করছে।
কে এই শহীদুল আহসান
দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, শহীদুল আহসানের আবির্ভাব হয় বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর। তিনি সেই সময়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দিতেন। তবে তার কর্মকান্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করেন ব্যারিস্টার মওদুদ। এরপর থেকে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আবদুল জলিলের সঙ্গে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালকও হন। আবদুল জলিল বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে শহীদুল কোটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ বিষয়ে তার কেলেঙ্কারি জানতে পারায় জলিল সাহেব তাকে দূরে সরিয়ে দেন। পরিচালক পদও হারান তিনি।
এরপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স’। সেখানেও তার নানা ধরনের অনিয়ম চলতে থাকে। এরপর আবারও ক্ষমা চেয়ে আবদুল জলিলের সঙ্গে যোগদান করেন। পুনরায় মার্কেণ্টাইল ব্যাংকের পরিচালক হন। এরপর থেকে শুরু নামে-বেনামে ঋণ নেওয়া ও জালিয়াতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদুল আহসান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যারা আমাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেছে তাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ দিচ্ছি। এজন্য ব্যারিস্টার রফিক উল হকের সঙ্গে চুক্তি করেছি।’
(দ্য রিপোর্ট/এআইএন/এইচএসএম/এনআই/জানুয়ারি ০৮, ২০১৪)