সুশাসনের সু-বাতাস বয়নি
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক পাঁচটি খাতের মধ্যে ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ ছিল পঞ্চম প্রতিশ্রুতি। অগ্রাধিকারভিত্তিক অন্য চারটি খাতের চেয়ে সুশাসনের প্রতি সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল।
আটটি উপ-দফায় ভাগ করে দেওয়া এ সব প্রতিশ্রুতির মধ্যে কয়েকটি খুব ভালোভাবে রক্ষা করতে পেরেছে সরকার। বিপরীত চিত্রে এই খাতে ব্যর্থতার পাল্লাও ভারি। কয়েকটি প্রতিশ্রুতি আংশিকভাবে চলমান থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ একাধিক প্রতিশ্রুতির কাজই শুরু করেতে পারেনি সরকার।
প্রথম দফায় উল্লেখিত ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ শক্তহাতে দমন করা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।’
এই ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য ঈর্ষণীয়। মহাজোট সরকারের আমলে জঙ্গিবাদের মাথাচাড়া লক্ষ্য করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন উগ্রপন্থী গ্রুপের বিরুদ্ধে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পেরেছে ।
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ও বিচার সম্পন্নের কাজ এখনো চলছে। ইতোমধ্যে একজনের দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে। ইতিহাসের নতুন পথে চলতে শুরু করেছে বাংলাদেশ।
‘বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে’ ইশতেহারে উল্লেখিত এই প্রতিশ্রুতির প্রতি সুবিচার হয়নি বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বিশিষ্টি আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ক্রমান্বয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার চিত্রই আমরা দেখতে পাচ্ছি। সব সরকারের আমলেই এই দৃশ্য দেখা যায়। নিজের দলের জন্য সুবিধাজনক রায় সরকারগুলো স্বাগত জানায়, কার্যকর করে। নিজেদের স্বার্থের বিপক্ষে যায় এমন বিষয় তারা এড়িয়ে চলেন।’
তরুণ সংবিধান গবেষক আরিফ খান বলেন, ‘বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার জন্য আলাদা সচিবালয় গঠন করা হয়নি। অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিধানে আদালতের রায়ের বরখেলাপ করে নিজেদের হাতে নিয়ন্ত্রণ রেখেছে সরকার। মৌলিক এই চিত্রগুলো দেখলেই বিচার বিভাগ বিষয়ে সরকারের কার্যক্রমের মূল্যায়ন আমরা দেখতে পাই।’
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন এবং কয়েকজনের রায়ও কার্যকর করা হয়েছে। তবে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার সম্পন্নের প্রতিশ্রুতি মহাজোট রক্ষা করতে পারেনি।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের উল্লেখ থাকলেও বর্তমান সরকারের সময়েও ক্রসফায়ার এবং গুম সংক্রান্ত বিষয় ছিল অন্যতম আলোচনার বিষয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক মানবাধিকার সংগঠন বিভিন্ন সময়ে তাদের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ সব অভিযোগ তেমন আমলে নেওয়া হয়নি।
সরকারের শেষের দিকে এসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তেমন কোনো ঘটনা লক্ষ্য করা না গেলেও রাজনৈতিক সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে মানুষ হত্যার বিষয়টি সমালোচিত হয়েছে।
দ্য রিপোর্টকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘যে কোনো একটি চলমান প্রক্রিয়া বন্ধ করতে সময় লাগে। বর্তমান সরকারের আমলে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি ঠিক, পরিমাণে অনেক কমেছে। আমরাও সাধ্যমতো সরকারকে সতর্ক করতে চেষ্টা করেছি।’
ইশতেহারের দ্বিতীয় দফায় শক্তিশালী স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগের উল্লেখ ছিল। এই ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে সরকার। কমিশনের জনবল আইনগত কাঠামো প্রত্যাশা পূরণ করার মতো কোনো কার্যক্রম মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। অন্যদিকে ন্যায়পাল নিয়োগই করা হয়নি।
তৃতীয় দফায় নির্বাচন কমিশন সংস্কার, কার্যকর সংসদ, সরকারের জবাবদিহিতা, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব, আয়ের উৎস এবং সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিষয়গুলোতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারেনি সরকার। ক্ষমতাসীন কারো সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। কার্যকর সংসদের চেহারা পাওয়া যায়নি বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকার কারণে।
অবশ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে যে নতুনত্ব আনা হয়েছে তাতে পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতায় সেটা উত্তীর্ণ হতে পারেনি বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনে নতুনত্ব আনলেও উদ্দেশ্যগত সততা ছিল না। কমিশনের বর্তমান কার্যক্রম দেখে এটা আরো বেশি পরিষ্কার হয়। নির্বাচন কমিশন যেন সরকারের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’
জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও মহাজোট শাসনামলে একাধিক সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
রামু-উখিয়া, পাবনা, বরিশালসহ বেশ কিছু জায়গায় সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়েছেন। এ সব ঘটনার সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দল-গোষ্ঠীর মতো সরকারি দলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও উঠে এসেছে।
দলীয়মুক্তকরণ অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অরণ্যেরোদন হিসেবেই থেকেছে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে বলে উল্লেখ করা হলেও এ সব ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল তীব্র।
তথ্য অধিকার এবং ই-গভর্নেন্স বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ প্রসংশিত হয়েছে। এ সবের সীমিত সুযোগ মানুষ ভোগ করতে পারছে। প্রতিশ্রুত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করার প্রতিশ্রুতি শেষ মুহূর্তে পূরণ করেছে সরকার।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুলিশ বিভাগের আধুনিকায়নে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বাহিনী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। সংশ্লিষ্টদের মতে অন্যান্য সরকারের মতো এই সরকারের আমলেও পুলিশ দলীয় প্রভাবের বাইরে ছিল না।
পুলিশের সাবেক আইজি (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ) এ এস এম শাজাহান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আইনগতভাবে পুলিশকে তাদের কাজে স্বাধীনতা দিতে হবে। আইনী স্বাধীনতা না থাকলে মুখের কথা কিংবা নির্বাচনী ইশতেহারে যাই থাকুক, তাতে কাজ হবে না। এ সব প্রতিশ্রুতি নির্বাচনের আগে সব দলই দিয়ে থাকে।’
(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এসবি/এনআই/জানুয়ারি ০৮, ২০১৪)