দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : ছয় বছর পার হলো নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছে। কিন্তু যে কারণে এই স্বাধীন বিচার বিভাগ গঠন করা হলো তার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

এখনও গঠন করা হয়নি বিচার বিভাগের স্বাধীন সচিবালয়। ফলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি-বদলিসহ যাবতীয় কাজের সাচিবিক দায়িত্ব আইন মন্ত্রণালয়ই পালন করছে। শুধু তাই নয়, বিচারকদের বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই প্রয়োজন হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়কে। নামমাত্র সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন নেওয়া হয়ে থাকে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে কাগজে কলমে। বিচার বিভাগের ওপর সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্ব এবং প্রশাসনিক তদারকির যে বিধান রয়েছে প্রয়োজনীয় জনবল, অর্থবলের ব্যবস্থা বর্তমান সরকার করেনি। ফলে আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে নিম্ন আদালতগুলো পরিচালিত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচার বিভাগ পৃথক হলেও জনগণের আশা কতটা পূরণ হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কারণ স্বাধীন বিচার বিভাগে দিন দিন বাড়ছে মামলাজট। বিচারপ্রার্থীরা যেখানে দ্রুত বিচারের পরিবর্তে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নিম্ন আদালতগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব বেশি থাকার কারণে রাজনৈতিক হয়রানি মামলায়ও জামিন দেওয়া হচ্ছে না। যে কারণে জামিন নিতে উচ্চ আদালতে যেতে হচ্ছে। এ সব কারণে বিচার বিভাগ মামলার পাহাড়ে পরিণত হয়েছে।

এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমান সরকার বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করেছে। বিশেষ করে নিম্ন আদালতে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব এবং আইন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রভাব এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

তিনি বলেন, এতে করে বিচার বিভাগ পৃথক করার প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবে ফলপ্রসূ হয়নি। বিচার বিভাগের ওপর বিচার প্রার্থীদের আস্তার চরম অবনতি ঘটেছে। বিচারক নিয়োগে দলীয়করণের কারণে বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পরও মামলাজট বেড়েই চলেছে অস্বাভাবিকভাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই সেখানে সমস্যাও কম। কিন্তু বিচারক নিয়োগে সবচেয়ে বড় সমস্যা রয়ে গেছে। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সফল করতে হলে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের একমাত্র যোগ্যতা হতে হবে মেধা, যোগ্যতা, সততা ও নিরপেক্ষতা প্রভৃতি মাপকাঠি।

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমদ বলেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ অর্থ হল অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা, পদন্নোতি, বদলি প্রভৃতি এককভাবে সুপ্রিম কোর্ট সম্পন্ন করবে। কিন্তু এ সব কাজ আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন নিয়ে করছে। যা বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের সর্বনিম্ন (বিচারক) পদে নিয়োগ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর আইনে স্নাতক ডিগ্রী থাকতে হবে। পাশাপাশি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। ফলে উচ্চ আদালতে কিছু সংখ্যক বিচারক রয়েছে যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অধস্তন আদালতের সর্বনিম্ন পদের কর্মকর্তার চেয়েও নিম্নতর। গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয় বলে মত দেন তিনি।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মামলার আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে কয়েকদফা সময় নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এ সংক্রান্ত একটি গেজেট ২ জুন প্রকাশ করা হয়। পরদিন তা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উপস্থাপন করা হলে আদালত তা গ্রহণ করে।

একই দিনে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ, সাময়িক বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৭ সংশোধনে সরকারকে ছয় সপ্তাহ সময় দিয়েছেন আদালত।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মামলার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম জানান, সুপ্রিম কোর্টের ১২ দফার আলোকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে। কিন্তু তা প্রকৃত রূপ এখনও পায়নি। আর এ জন্য প্রায় সুপ্রিম কোর্টের কাছে নতুন নতুন আবেদন নিতে হচ্ছে। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন এবং রায় বাস্তবায়নের জন্য প্রায়ই সরকারকে নির্দেশনা দিয়ে থাকে বলে জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর ১২ দফা নির্দেশনার আলোকে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার রায় দেন। তবে রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছার অভাবে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে ওই রায় বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সে আলোকে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে স্বাধীন বিচার বিভাগের যাত্রা শুরু হয়।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এসবি/আরকে/জানুয়ারি ০৮, ২০১৪)