দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্ব ছিল আওয়ামী লীগের। সরকারে এসে উল্টো দুর্নীতি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হতে হয়েছে সরকারকে।

এই সরকারের আমলে প্রকাশিত পদ্মা সেতু, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকসহ সরকারি শাসনে পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক অনিয়মের ক্ষেত্রে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। এ সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসহ কানাডার আদালতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী, সচিবদের নাম দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচিত হয়।

আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারের অগ্রাধিকারমূলক পাঁচটি বিষয়ের দ্বিতীয় ধাপে রাখে দুর্নীতি প্রতিরোধের অঙ্গীকার। এতে বলা হয় ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণী দিতে হবে।

রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা ও পেশীশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দফতরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডের ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।’

সরকারে যাওয়ার আগে দেওয়া লিখিত ইশতেহারের এই অংশটির ওয়াদা একদিকে যেমন সরকার রাখতে পারেনি, বিপরীত দিকে এ সব ওয়াদার অধিকাংশই ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি সরকার। অনেক ক্ষেত্রে তার উল্টো চিত্রই ফুটে উঠেছে।’

সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করতে পারেনি। উল্টো দুর্নীতি দমন আইনের সর্বশেষ একটি সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

দুদক আইনের সংশোধনীতে সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে সরকারের অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এই বিধানটি ছিল সাবেক দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময়কালে। মাঝখানে এই বিধান বাতিল হলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে সরকারের এই পদক্ষেপ ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।

১০ নভেম্বর ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন সংশোধনী বিল-২০১৩’ পাস করা হয়। এই আইন অনুযায়ী জজ, ম্যাজিস্ট্রেট ও সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। পূর্বে দুদক নিজে থেকে মামলা করার এখতিয়ার রাখত। এতে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান স্বয়ং উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

মন্তব্য জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টরন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক

ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দুদক আইনের সংশোধনী পুরোপুরি অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক, প্রতারণামূলক আত্মঘাতী ও গভীরভাবে হতাশাব্যঞ্জক।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘চুপিসারে এই বিলটি পাস করা হয়েছে। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সরকার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ সচেষ্ট হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী যদি সবাই সমান হন তাহলে এই আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না।’

এই বিষয়গুলো সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকার করা না হলেও মানুষের ধারণায় বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ওঠা বিতর্কে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে প্রত্যাহার ও সচিবের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সরকার এই দায় স্বীকার করেনি।

ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করার বিধানও জারি করেনি সরকার। সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা ও পেশী শক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি।

তবে সরকারের বিভিন্ন দফতরে কম্পিটারায়নের বিষয়টি লক্ষ্যণীয়ভাবে এগিয়েছে। এই দফায় উল্লেখিত প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নাগরিক সনদ উপস্থাপনের বিষয়টি অনেক প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়। কিন্তু পদ্ধতিগত উন্নতি না হওয়ায় এ সব নাগরিক সনদ যেন নাগরিকদের প্রতিই পরিহাস করে চলেছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কোনো সরকারই তাদের মুখের কথার সঙ্গে কাজের মিল রাখতে পারে না। এই ধারাটা দিন দিন আরো বাড়ছে। যতই দিন যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রতিশ্রুতির পরিমাণ বাড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রমের গুণগতমান উন্নত হচ্ছে না।’

(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এসবি/ এনআই/জানুয়ারি ০৮, ২০১৪)