বিদ্যুৎ ও জ্বালানি : সাফল্য-সমালোচনা দুটোই
মহাজোট সরকারের আগের দুটি সরকার বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে। মহাজোটের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল এই সমস্যার সমাধান। সমাধান কিছুটা হয়েছে। তবে সেটি অনেক বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এই দুটি খাতের মধ্যে বিদ্যুতে সরকারের ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে। বিগত কোনো সরকারই বিদ্যুৎখাতে এত বড় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। তবে সরকারের এই সাফল্য প্রশ্নাতীত নয়।
জ্বালানিখাতেও সরকারের উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন থাকলেও সামগ্রিক বিচারে বিদ্যুতের চেয়ে জ্বালানিখাত যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। এই দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত। জ্বালানিখাতে প্রত্যাশিত অর্জন হলে বিদ্যুতে আরও বেশি উন্নয়ন সম্ভব ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা আছে সাড়ে নয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার জোর দিয়েছে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল পদ্ধতির ওপর। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী এ সব কুইক রেন্টালের মেয়াদ হওয়ার কথা তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারের দীর্ঘমেয়াদী কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসতে না পারায় সরকারের পক্ষ থেকে এ সব কুইক রেন্টাল প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তির মেয়াদ আরও বাড়ানো হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিকে টেকসই মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা।
অনেকে শটকাট এই বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতিকে লুটপাট করার হাতিয়ার হিসেবে অভিহিত করেন। এ সব অভিযোগের ক্ষেত্রে শক্ত ভিত্তিমূল জন্মায় দায় মুক্তির আইনটিকে কেন্দ্র করে।
সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে দায়মুক্তিমূলক একটি আইন জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। ঐ আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো বিষয় নিয়ে কোনো আদালতে যাওয়া যাবে না।
তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎখাত থেকে লুটপাটের রাস্তা প্রশস্ত করেছে। তারা দায়মুক্তির আইন করে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল করতে পারলো সাফল্যের সঙ্গে। অথচ একই পরিকল্পনায় থাকা বেইজলোড কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন স্থাপন করতে পারলো না। কারণ তারা জানেন কুইক রেন্টাল বন্ধ হয়ে গেলে কুইক আয়ও বন্ধ হয়ে যাবে।’
এই সরকারের উদ্যোগে এখন পর্যন্ত ৬০টির মতো ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে আরও ৩০টির বেশি।
বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ৪৫০ মেগাওয়াটের হরিপুর স্টেশন চালু হলে জ্বালানির অভাবে পুরোপুরি উৎপাদনে আসতে পারছে না। বাকি বেইজলোড বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ এই সরকারের মেয়াদে শেষ হওয়ার সুযোগ নেই।
বিদ্যুৎখাতে সরকারের বাড়তি আরেকটি উদ্যোগ হলো ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা। সেই সঙ্গে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নির্বাচনী ঘোষণারও বেশ অগ্রগতি করেছে সরকার। যদিও বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা বাস্তবসম্মত কি না তা নিয়ে যথেষ্ট বির্তক রয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ক্রমেই কমিয়ে আনছে। তখন দিনের শেষে বিদ্যুতের বিশাল অর্জন বির্তকমুক্ত থাকতে পারেনি।
বিদ্যুৎখাতে উৎপাদন বৃদ্ধির রেকর্ডের সঙ্গে দাম বৃদ্ধির রের্কডও হয়েছে মহাজোট সরকারের আমলে। বর্তমান সরকারে সময়কালে ৫ দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। যা অন্য কোনো সরকারের আমলে হয়নি।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ও ভর্তুকি দিয়ে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ কয়েক শ’ কোটি টাকা খরচ করেই আমরা পেতে পারি।’
তার মতে, ‘আমাদের যেসব পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে সেগুলো যদি মেরামত করা হয় তাহলে অনায়াসে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে পারি। কিন্তু সরকার সেদিকে যাচ্ছে না, যাবেও না।’
জ্বালানিখাত : জ্বালানিখাতে বর্তমান সরকারের অনেক পরিকল্পনার কথা ইশতেহারে পাওয়া যায়। বাস্তবে তার উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন নেই। মূলত জ্বালানিখাতে বড় পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতের অগ্রগতির আশা করা হয়েছিল। সেই আশা পূরণ করতে পারেনি সরকার। যে কারণে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের ওপর অনেক বেশি ভরসা করতে হয়েছে। এর জন্য একদিকে বেড়েছে জ্বালানি ব্যয়, অন্যদিকে ভর্তুকি।
পেট্রোবাংলার হিসাবে এই সরকারের আমলে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন বেড়েছে ৬০ কোটি ঘনফুট। জ্বালানি অনুসন্ধানে বিনিয়োগ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। কেনা হয়েছে নতুন দুটি রিগ, যা আগামী দিনে জ্বালানি সক্ষমতা বাড়াতে সহযোগিতা করবে।
আগামীতে বিশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের যে পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার বেশির ভাগই কয়লাভিত্তিক। অথচ গত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করে যাওয়া খসড়া কয়লানীতিকে এখনও চূড়ান্ত রূপ দিতে পারেনি সরকার।
নবায়ণযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে গৃহস্থালি কাজের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে সৌর বিদ্যুতের আগ্রহ তৈরি হলেও ব্যাপক আকারে সরকারের কোনো উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়।
পাওয়ার সেল-এর সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমত উল্লাহ বলেন, ‘বাতাস, পানি, রোদ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে সব শর্ত পূরণ করা দরকার আমাদের আবহাওয়া সেক্ষেত্রে আদর্শ। কিন্তু কোনো সরকারই এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয় না। কারণ তারা এখান থেকে টাকা কামাই করতে পারবেন না। যেদিকে টাকার উৎপাদন আছে সরকারগুলোর আগ্রহ মূলত সেইদিকে।’
(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এসবি/রা/জানুয়ারি ০৮, ২০১৪)