নূরুজ্জামান তানিম, দ্য রিপোর্ট : পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলা পরিচালনায় প্রস্তাবিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের দেশেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বাইরের দেশগুলোতে সিকিউরিটিজ আইনের ওপর বিচারকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ একাডেমি না থাকায়, দেশেই তা চালু করার কথা ভাবছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল ট্রেনিং একাডেমির সিলেবাসে সিকিউরিটিজ আইন অর্ন্তভুক্ত করার বিষয়ে বিএসইসির পক্ষ থেকে সরকারকে অবহিত করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় শেয়ার বাজারের উন্নয়নে সরকার যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট বিচারকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার শর্ত রয়েছে। প্রশিক্ষণ না দিলে এডিবি অর্থ ছাড় দেবে না। এডিবির শর্ত অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর বিচারককে বিদেশে প্রশিক্ষণ দিতে বিএসইসিকে নির্দেশ দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। গত ২১ অক্টোবর অর্থমন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বিএসইসিতে পাঠানো হয়েছে।

এডিবির শর্ত অনুযায়ী, বিচারকের প্রশিক্ষণের ব্যয় বিএসইসিকে বহন করতে হবে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নতুন করে প্রসিডিউর অব আপিলের ব্যবস্থা রাখার শর্তজুড়ে দিয়েছে এডিবি।

জানা গেছে, ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়ে নির্দেশ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আইন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ফাইল চালাচালি চলছে। বিএসইসি ও আইন মন্ত্রণালয় উভয়ই ট্রাইব্যুনালের জন্য জায়গা খুঁজছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন কোর্টের আশপাশে ট্রাইব্যুনাল বসানোর বিষয়ে বিএসইসির ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে।

ইতোমধ্যে বিচারকের প্রশিক্ষণের সকল খরচ বহন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। ট্রাইব্যুনালের বিচারক সিকিউরিটিজ আইনের ওপর কোনো একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নেবেন তা নির্ধারণের জন্য ভারত ও আমেরিকার সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনে খোঁজ নেওয়া হয়। তবে তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় পরবর্তীকালে কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় দেশেই বিচারকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে সম্মতি দেওয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটে জুডিশিয়াল ট্রেনিং একাডেমির কারিকুলামে সিকিউরিটিজ আইন অর্ন্তভুক্ত করার বিষয়ে সরকারকে অবহিত করার পক্ষে মতামত দেন কমিশনাররা।

এদিকে, দেশে ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোর্টে বাদি বা বিবাদি পক্ষের আপিলের সুযোগ থাকার পরও কেন এডিবির পক্ষ থেকে নতুন এ শর্তজুড়ে দেওয়া হয়েছে তা বিএসইসির বোধগম্য নয়। এডিবি যখন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল তখন বিচারকদের বিদেশে প্রশিক্ষণের শর্ত ছিল না। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠনের শেষ পর্যায়ে একের পর এক শর্ত দিচ্ছে এডিবি। এত স্বল্প সময়ে এ সব শর্ত পরিপালন কষ্টসাধ্য বলে মনে করছে কমিশন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির একজন কমিশনার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল গঠনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এ লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রণালয় ও বিএসইসি একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। বিদ্যমান আইনেই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সম্প্রতি এডিবি আবারও ট্রাইব্যুনাল গঠনের লক্ষ্যে বিচারককে বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়ার নতুন শর্ত দিয়েছে। বিদেশে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ একাডেমি না থাকায়, দেশেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ভাবছি। তাই জুডিশিয়াল ট্রেনিং একাডেমির সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য সরকারকে অবহিত করার চিন্তা করছি। সিলেবাসে সিকিউরিটিজ আইন সংযোজন করে, সিকিউরিটিজ আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’

এদিকে, বিদ্যমান আইনেই পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এডিবির ঋণ সহায়তাপুষ্ট ‘ইনহ্যানসিং ইফিসিয়েন্সি অব দ্য ক্যাপিটাল মার্কেট’ প্রকল্পের পরামর্শক মিখেল ফারনেল এবং তাদের স্থানীয় পরামর্শক ব্যারিষ্টার আফজালের পরামর্শে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পরামর্শকদের মতে, বিদ্যমান আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে আপাতত কোনো বাধা নেই। বিদ্যমান আইনে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ এর ১৭-ধারা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ২৪ ধারায় শাস্তি ও ২৫ ধারায় অপরাধ আমলে নেওয়ার বিধান উল্লেখ রয়েছে। ওই অধ্যাদেশের সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে ২৫-বি ধারা সংযোজন করে এক বা একাধিক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। যা গত বছরের ১০ ডিসেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

গেজেটে একজন দায়রা জজ বা অতিরিক্ত দায়রা জজের সমন্বয়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। সরকার তাঁকে নিয়োগ দেবে। তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর অধীনে সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। এ ক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ সংক্রান্ত ফৌজদারি অপরাধের বিচার করার ক্ষেত্রে বর্তমানে দায়রা আদালতে যে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করছেন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল চালুর পর একই আইনে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। এ ছাড়া দায়রা আদালতের বিচারাধীন কমিশনের ফৌজদারি মামলাসমূহ ওই ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হবে।

জানা গেছে, গত ২৪ নভেম্বর সচিব কমিটির সভায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের ক্ষেত্রে একজন বিচারকসহ মোট ৬ সদস্যের জনবল কাঠামোর প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ২০১২ এর ২৫(বি) ধারা অনুসারে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে একজন দায়রা জজ বা অতিরিক্ত দায়রা জজের বেতন স্কেল ৩৬ হাজার থেকে ৩৯ হাজার ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এ বিষয়ে বিএসইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কাজ এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে কমিশন। এ বিষয়ে এডিবির পরামর্শেকের সঙ্গে কমিশনের আলোচনা হয়েছে। ওই আলোচনায় নেওয়া সিদ্ধান্ত বা পরামর্শ মন্ত্রণালয়কে অভিহিত করেছে কমিশন। এখন অর্থমন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। শিগগিরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত নির্দেশনা আসবে।’

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/ডব্লিউএন/সা/জানুয়ারি ৯, ২০১৪)