মতুয়া ধর্ম
‘জীবে দয়া, নামে রুচি, মানুষে নিষ্ঠা’
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : মতুয়া ধর্মকে বলা হয়, আদর্শ গার্হস্থ্য ধর্ম। এটি ৩টি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত- জীবে দয়া, নামে রুচি ও মানুষে নিষ্ঠা। মতুয়া মতবাদের প্রধান দিক হলো- হাতে কাম (কাজ), মুখে নাম, মূলমন্ত্র হরিনাম। বাংলা অঞ্চলের ভক্তিবাদ সিক্ত আরেকটি ধর্ম হলো মতুয়া ধর্ম। অনেকে একে সিন্ধু উপত্যকায় জন্ম নেওয়া সনাতন ধর্মের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখেন। মনে করা হয় আদি জাতপাতহীন সনাতন ধর্ম বর্ণবৈষম্য ও জাতিভেদ প্রথার মধ্যে হারিয়ে গেছে।
এই ধর্ম জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা বিরোধী। বলা হয়ে থাকে অস্পৃশ্যতা, অবহেলা ও ছুৎমার্গের ফলে অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত লোকজন যখন দলে দলে ধর্মান্তরিত হচ্ছিল, তখনই আবির্ভূত হন পরম প্রেমময় যুগাবতার মানবতার ধ্বজাধারী মুক্তিদাতা পূর্ণব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর।
‘হরিচাঁদ এসেছিলেন তরাতে এ জাতি, সে কাজে মতুয়া সব আছে মর সাথি।’
দেশভাগের পর এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বহু নিম্নবর্ণের মানুষ উদ্বাস্তু হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নেন। তাদের মধ্যে মতুয়া ধর্মাবলম্বীরাও আছেন। তবে এখনও তাদের বেশ বড় একটা অংশ বাংলাদেশে রয়েছেন।
হরিচাঁদ ঠাকুর : গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার ওড়াকান্দির সাফলিডাঙ্গা গ্রামে ১২১৮ বঙ্গাব্দের ২৯ ফাল্গুন বা ১৮১২ সালের ১৩ মার্চ শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা যশোমন্ত ঠাকুর ও মা অন্নপূর্ণা দেবী। নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের যশোমন্ত বৈষ্ণবভক্ত হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মেছিলেন এক মাহেন্দ্রক্ষণে। জন্মের সময় তাঁর শরীরে বত্রিশ রকমের লক্ষণ ছিল, যা হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী অবতার পুরুষের বিশেষ লক্ষণ। হরিচাঁদ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন ১৮৭৮ সালে।
এক বর্ষায় তিনি বাবার সঙ্গে নদীয়ার মায়াপুর ঘুরতে যান। সেখানে এক জোছনারাতে চাতালে শুয়েছিলেন। ঘুমের ভিতরে দেখা দেন বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরুষ শ্রী চৈতন্যদেব! ঘুম ভেঙে গেলে হরি ঠিক করলেন ওড়াকান্দি ফিরে শ্রীচৈতন্য যা যা প্রচার করে গেছেন তা-ই প্রচার করবেন। সে মোতাবেক ওড়াকান্দি ফিরে চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তির কথা সহজ সরলভাবে প্রচার শুরু করেন হরি।
মতুয়াবাদ : তিনি যা যা বললেন তার সব-ই কালক্রমে হয়ে গেল মতুয়াবাদ। অন্যভাবে বললে, যিনি হরির কথায় মাতোয়ারা হন তিনিই মতুয়া। মতুয়া শব্দের অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা হওয়া। হরিনামে যিনি মেতে থাকেন বা মাতোয়ারা হন তিনিই মতুয়া। লোকে তাঁর অনুসারীদের বলে মতুয়া। স্থানীয় ভাষায় : মউত্তা। ভক্তরা হরিচাঁদকে বিষ্ণুর অবতার মনে করে। তাই তারা নেচে নেচে গান-
‘রাম হরি কৃষ্ণ হরি হরি গোরাচাঁদ, সর্ব হরি মিলে এই পূর্ণ হরিচাঁদ।’
জাতপাত বিরোধিতা : মতুয়াদের আচার বর্ণপ্রথা বিরোধী। বিবাহ ও শ্রাদ্ধের মতো অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত লাগে না, গোসাঁইদের দ্বারা সব হয়ে যায়। হিন্দুধর্মের মধ্যে পুরোহিত ব্রাহ্মণ ও তার ছেলে এবং নাতি ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। হরিচাঁদ এই নিয়ম ভেঙে দেন। তিনি ঘোষণা করেন এই ধর্ম সব মানুষের জন্য। পতিত ও শূদ্রদের জন্য এটি বিকল্প পথ। এই ধর্মে মূর্ত হয়ে উঠেছে ধর্ম সংস্কার, গার্হস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা, ইহকালবাদী প্রেম ও ভক্তি।
হরিচাঁদ ‘হাতে কাম, মুখে নাম’ এই বাণীর মাধ্যমে বলেন, ‘নমঃশূদ্ররা কারো চেয়ে হীন বা নিচু নয়। কাজ করা বড় ধর্ম, শ্রমে অংশ নাও এবং গার্হস্থ্য জীবনে থাকো। কারও কাছে দীক্ষা নিও না বা তীর্থস্থানে যেও না। ঈশ্বর সাধনার জন্য ব্রাহ্মণদের মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই।’
হরিচাঁদ ঠাকুর বলেন-
‘কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই।
বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় হইবেক যেই।
না থাকুক আচার ক্রিয়া কর্ম হরি তুল্য সেই।।’
অর্থাৎ, বেদ ও অন্যান্য হিন্দুধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থ, আচার-আচরণ এসব কিছুকে তিনি পরিহার ও অস্বীকার করেছিলেন। হিন্দুধর্ম ও তার দেব-দেবীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি আজীবন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গেছেন।
তিনি বলেন, বৈদিক ক্রিয়াকর্মে আস্থাশীল হওয়া ঠিক না। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হওয়াই যুক্তিসম্মত। জীবনের লক্ষ্য হলো প্রেম ও ভক্তি দ্বারা হরির সাধন। আর সাধনমার্গে নারীপুরুষের অধিকার সমান।
গার্হস্থ্য আশ্রম : মতুয়া ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গার্হস্থ্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা। সংসারকে তিনি সব আশ্রমের সার বলেছেন। বলা হয়ে থাকে, সংসার জীবনে প্রশান্তি দেবার জন্যই তিনি এসেছিলেন। তিনি নারী-জাতিকে মায়ের আসনে বসিয়ে সম্মান দিয়েছেন। তিনি বলেন, নারী সাধন পথের সহায়ক।
সংসার উপেক্ষা করে কোনো ধর্মাচরণ অচিন্ত্যনীয়। সংসারে থেকেই মানবজীবনকে সুন্দর, সুষ্ঠু ও পবিত্রতার মধ্যে গড়ে তুলে শান্তি পাওয়া যায় এবং ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায়। এমন দর্শন প্রচার করেছেন হরিচাঁদ ঠাকুর। সংসারে থেকেই ব্রহ্মচর্য-বানপ্রস্থ-সন্ন্যাস সবই পালন সম্ভব। প্রয়োজন নেই অরণ্যচারী বা উদাসী হওয়ার। তিনি গার্হস্থ্য আশ্রমের মাধ্যমে ব্যক্তি কল্যাণ থেকে সামগ্রিক কল্যাণের কথা বলেন।
অশ্বিনী গোঁসাইয়ের মতে- ‘যে জন রক্ষা করে পিতৃধন, বাপের ব্যাটা হয় সে বিচক্ষণ।’
ধর্মগ্রন্থ : ১৮৪৭ সালের নভেম্বর মাসে নড়াইলের জয়পুর গ্রামে কবিয়াল তারকচন্দ্র সরকার জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত। হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবন ও আদর্শ নিয়ে কবিয়াল শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থ রচনা করেন। এটিই মতুয়াদের পবিত্র গ্রন্থ। এই গ্রন্থ পাঠ ছাড়াও মতুয়ারা হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা মেনে চলে।
হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা
১. সদা সত্য কথা বলবে।
২. পিতা-মাতাকে দেবজ্ঞানে ভক্তি করবে।
৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে।
৪. জগতকে ভালোবাসবে।
৫. সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে।
৬. জাতিভেদ করবে না।
৭. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে।
৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে।
৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে।
১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না।
১১. ষড়রিপু বশে রাখবে।
১২. হাতে কাম ও মুখে নাম করবে।
প্রধান তীর্থ : মতুয়াদের প্রধান মন্দিরটি ওড়াকান্দি গ্রামে। ফাল্গুন মাসের জন্মতিথিতে প্রতিবছর ওড়াকান্দিতে দেশ-বিদেশের মতুয়ারা সম্মিলিত হন এবং হরিচাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিকতা : এই ধর্মের অনুসারীরা বুধবারে সমবেত প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেন। একে বলা হয় হরিসভা। এখানে হরির প্রশংসা করে কীর্তন গাওয়া হয়। গানে থাকে প্রেম ও ভক্তিরসের প্রাধান্য। প্রতিটি গানের শেষে ভনিতায় রচয়িতার নাম থাকে। ভক্তরা নেচে নেচে গান পরিবেশন করে। গানের সঙ্গে সঙ্গে ঢাক, শিঙা, কাঁসর ও ঝাঁঝর বাজানো হয়। তাদের গলায় শোভা পায় নারিকেলের মালা। তাদের শোভাযাত্রায় থাকে লাল নিশান। এই নিশান শান্তির প্রতীক আর পতাকা হলো ধর্মধ্বজা।
হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রার্থনাসভায়ও অনিবার্য ছিল গান। গান তার ভক্তরাই রচনা করত। সেই গানকে এখন বলা হয় মতুয়া সংগীত। সে গানে থাকত হরিনামের মাহাত্ম্য। কখনো কখনো হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রশংসাও থাকত।
‘মতুয়ার প্রেমভক্তি অ’কামনা, তন্ত্র-মন্ত্র নাহি জানে ব্রজ উপাসনা।’ - শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত
মতুয়া ধর্ম ব্রজতত্ত্ব বা ব্রজউপাসনার উপর দাঁড়িয়ে। এখানে উপাসনার জন্য বৈদিক মন্ত্রের দরকার পড়ে না। ব্রজের শ্রীমতি যেমন পরমাধ্যেয় শ্রীহরি’কে পাওয়ার জন্য কেবল হা’কৃষ্ণ হা’গোবিন্দ বলে ধুলায় গড়াগড়ি যে’ত, চতুর্দিকে শ্যামময় দেখত, তাঁকে ডাকার জন্য কোনও মন্ত্র তন্ত্র বা পূজাপার্বণের দরকার হত না। কোনো গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণের দরকার হত না। বরং, রাগানুরাগ প্রেমমার্গের মাধ্যমেই তাঁর কাছে পৌঁছে যেত। তেমনি মতুয়ারাও শুধুমাত্র ‘হরিবল’ বলে সেই শ্রীহরির প্রেম প্লাবনে ভেসে যান।
‘হরিচাঁদ চাকচিক্য লেগেছে চক্ষেতে, আর কিছু পাই না আমি দেখিতে।’- অশ্বিনী গোঁসাই
‘তুমি বাস বা না বাস ভালো হরি তাতে ক্ষতি নাই, আমি তোমারে বাসিব ভালো এই ভিক্ষা চাই।’- অশ্বিনী গোঁসাই
মতুয়া আন্দোলন : হরিচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৭-১৯৩৭) মতুয়া আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে ‘চণ্ডাল’ নামের বদলে ‘নমঃশূদ্র’ নাম ব্যবহৃত হয়। নমঃশূদ্র ছাড়াও আরও অনেক নিম্নবর্ণের মানুষ যেমন-কাপালি, পৌণ্ড্র, গোয়ালা, মালো ও মুচি মতুয়া আন্দোলনে যোগ দেন।
বাবার নির্দেশের সঙ্গে গুরুচাঁদ যুক্ত করেন শিক্ষা বিস্তার এবং জমিদারবিরোধী আন্দোলন। এ ছাড়াও তিনি অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং গণস্বাস্থ্যের ওপর নজর দেন। কোনো গ্রামের মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার জন্য এলে তিনি তাদের কাছে এই শর্ত রাখতেন যে গ্রামে প্রথমে একটি স্কুল স্থাপন করতে হবে এবং মাঠে-ঘাটে মলত্যাগ না করে বাড়িতে পায়খানা বানাতে হবে। তাঁর বাণী ছিল, ‘তাই বলি ভাই মুক্তি যদি চাই বিদ্বান হইতে হবে, পেলে বিদ্যাধন দুঃখ নিবারণ চিরসুখী হবে ভবে।’
১৮৮০ সালে ওড়াকান্দি গ্রামে স্কুল স্থাপিত হয়। এটি ছিল নিজেদের জন্য নিম্নবর্ণের মানুষদের স্থাপিত প্রথম স্কুল।
মতুয়ারা ছিলেন প্রধানত ভূমিহীন কৃষক। জমিদার ও মহাজনদের শোষণে জর্জরিত। ১৯২১ সালে বাংলার বিধান পরিষদে নমঃশূদ্র নেতা ভীষ্মদেব দাস এবং নীরোদবিহারী মল্লিক তেভাগার দাবি উত্থাপন করেন। এঁরা দু’জনেই ছিলেন গুরুচাঁদের অনুসারী। ১৯৩৩ সালে ঘাটাইলে সর্বভারত কৃষক সভায় গুরুচাঁদ যোগ দিয়ে জমিদার প্রথা উচ্ছেদ ও তেভাগার দাবি রাখেন।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বিধানসভার ৩০টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ১২ জন ছিলেন নমঃশূদ্র, যাঁদের মধ্যে মাত্র ২ জন ছিলেন কংগ্রেসের, বাকি ১০ জন ছিলেন গুরুচাঁদের অনুগামী। বিধানসভায় রায়তদের অধিকার সংক্রান্ত বিল পাশ করানোয় এদের ভূমিকা ছিল। বর্তমানে মতুয়াদের একটি বড় অংশ ভারতে থাকেন।
(দ্য রিপোর্ট/ওএস/ডব্লিউএস/একেএম/এপি/জানুয়ারি ১০, ২০১৪)