বিরোধী দলবিহীন ‘জাতীয় সরকার’ গঠন হচ্ছে!
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোকে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘জাতীয় সরকার’ নামে একটি বিরোধী দলবিহীন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।
জাতীয় পার্টি ছাড়াও জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে নির্বাচিতদের নিয়ে এই ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা ইঙ্গিত দিয়েছেন। আর এমন সরকার গঠন করা হলে তা হবে বিরোধী দলবিহীন একটি সরকার। এক্ষেত্রে সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার কোনো প্রতিনিধি সংসদে থাকবে না বলে অভিমত বিশ্লেষকদের।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথের পর জাতীয় পার্টি সরকারের মধ্যে থেকেই প্রধান বিরোধী দল হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা আগামী সরকারের মন্ত্রিপরিষদে তাদের অংশীদারিত্ব এবং একই সঙ্গে সংসদে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখার বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। শপথের পর জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নতুন সরকারে জাতীয় পার্টির অংশীদারিত্বের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশন এরশাদের আলোচনা হয়েছে বলে জানা যায়।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া সব দল নিয়ে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করা হতে পারে এমন ইঙ্গিত দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৮ ডিসেম্বর দলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে সব দলের অংশগ্রহণে একটি ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
জাতীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে কথা বলা হলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়া সব দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনে সংবিধানে কোনো বাধা নেই। এক্ষেত্রে বিরোধী দল থাকছে কি থাকছে না, তাতে কোনো সমস্যা নেই।’
জাতীয় সরকার গঠনের ইচ্ছা ব্যক্ত করে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে জাতীয় সরকার বা ঐকমত্যের সরকার গঠন হলে খুবই ভালো হয়। এতে সংবিধানের কোনো লঙ্ঘন হয় না। কারণ সংবিধানে জাতীয় সরকার গঠনে কোনো বাধা নেই। বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গিপনার বিপরীতে দেশ আজ ঐক্যবদ্ধ।’
সব দলের অংশগ্রহণে ঐকমত্যের এমন সরকার গঠনে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা। তবে বিরোধী দলবিহীন সংসদ কতটুকু কার্যকর হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
বিরোধী দলবিহীন ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল কোনো মন্তব্য করতে চাননি। বিরোধী দল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিরোধী দল সাংবিধানিক কোনো বিষয় না। এটা সংসদের কার্যপ্রণালী দ্বারা নির্ধারিত।’
‘জাতীয় সরকারের’ বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ।
সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কখন কি করছে তা বলতে পারি না। জাতীয় সরকার সংবিধানে আছে কি নাই সেটা বিষয় না। সংবিধান দেখে বলে দিলেই হবে না। এটা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। তারপর মন্তব্য।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সমালোচিত কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না। মন্তব্য করলে দেখা যাবে একজনের পছন্দ হয়েছে, অন্যজনের হলো না। তখন তো আমার গালি শুনতে হবে। তাই এ বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য নয়।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যেভাবে তারা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করেছে সেভাবে জনগণকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকারের নামে আরেকটি ব্লাফ দেওয়ার চেষ্টা করছে। ‘যাহাই লাউ তাহাই কদু’র মতো করে মহাজোট জাতীয় সরকার বানানোর চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় সরকার হতে হলে দেশের সকল রাজনৈতিক দল, শ্রমজীবী, পেশাজীবী ও কর্মজীবীদের নিয়ে করতে হবে। যদি তা করে তাহলে অবশ্যই আমরা অভিন্দন জানাব।’
এ ব্যাপারে কথা বলা হলে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলো নিয়ে সরকার গঠন করলেই জাতীয় সরকার হয় না। জাতীয় সরকার অন্য বিষয়। আওয়ামী লীগ তাদের আগামী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা থেকেই এমনটি করতে পারে। আর জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সরকার গঠন করে তার নাম জাতীয় সরকার দিলেই হয় না।’
এ সব বিষয়ে কথা বলা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নুরুল আমীন বেপারি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যেখানে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেই জনগণ গ্রহণ করেনি, সেখানে কোন দলকে নিয়ে কী সরকার গঠন করা হলো- সেটা কিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়? আসলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে সন্তুষ্ট করে তাদের মেয়াদটা যতটুকু পারে বাড়িয়ে নিতে চায়। তাই এটা হবে বিরোধী মতাদর্শবিহীন একটি সরকার। এমন সরকার বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সরকারেরই অনুকরণ। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো বিরোধী দল রাখতে চাচ্ছে না।’
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিরোধী দলবিহীন কোনো সরকার গঠন করা হলে সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার কোনো শক্তি আর থাকছে না। এক্ষেত্রে সংসদে বা প্রশাসনে সরকার ইচ্ছামতো কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে। সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ থাকবে না।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিরোধী দলবিহীন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা হয় না। আর একটি কার্যকর সংসদই গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বিরোধী দলবিহীন জাতীয় সংসদ কার্যকর হওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এইউএ/বিকে/জেএম/শাহ/জানুয়ারি ১০, ২০১৪)