নূরুজ্জামান তানিম, দ্য রিপোর্ট : তালিকাভুক্ত ১৭ কোম্পানির বিষয়ে অধিকতর তদন্তে সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে এই ১৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করে তা অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশের আলোকে গত দেড় বছর ধরে এ সব কোম্পানির বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত করে বিএসইসি।

অধিকতর তদন্তে বহুল আলোচিত এই ১৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন উপায়ে কারসাজি, শেয়ার কেনা-বেচায় প্রলুব্ধ বা নিরূৎসাহিত করা, সিরিজ ট্রানজেকশন, ঘোষণা না দিয়ে শেয়ার কেনা-বেচা ও ওয়াশ সেল করার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের পরিবর্তে সিকিউরিটিজ আইনেই (সিভিল) ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

এর আগে ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ১৫টি এবং ২০১১ সালে দায়ের করা ২টি মামলার নিষ্পত্তি দীর্ঘদিনেও না হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে।

অভিযুক্ত কোম্পানিগুলো হল- বিডি থাই এলুমিনিয়াম, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (কেপিসিএল), জিএমজি এয়ারলাইনস, সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল (পূর্বতন চিটাগাং ভেজিটেবল অয়েল), বিচ হ্যাচারি, বিডি ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোডস লিমিটেড, সিএমসি কামাল, মেঘনা সিমেন্ট, মালেক স্পিনিং, অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেড, মবিল যমুনা লুব্রিকেন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, বারাকাতউল্লাহ ইলেকট্রো ডায়ানামিকস লিমিটেড, সালভো কেমিক্যাল, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, বিকন ফার্মা, এমআই সিমেন্ট এবং ফুওয়াং সিরামিক।

গত ৫ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত বিএসইসির ৪৯৯তম কমিশন সভায় উল্লিখিত ১৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে বিশদ আলোচনা হয়। ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হলে কমিশনের আইন বিভাগ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে পারবে। আর সিকিউরিটিজ আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হলে কমিশনের এনফোর্সমেন্ট বিভাগ সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে আলোচনায় উঠে আসে। পাশাপাশি পূর্বের দায়েরকৃত মামলাগুলোর বিষয়েও সভায় আলোচনা হয়।

অধিকতর তদন্ত কমিটি এবং কমিশনারদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ১৭ ধারা ভঙ্গের দায়ে এই ১৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ (সিভিল) আইনের ২২ ধারা মোতাবেক এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে কমিশনের এনফোর্সমেন্ট বিভাগকে এ বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অধিকতর তদন্তে কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ভঙ্গের প্রমান পেয়েছে বিএসইসি। অধ্যাদেশের ২২ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্তদের ন্যূনতম এক লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। অনাদায়ে প্রতিদিন অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করারও বিধান রয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৭ কোম্পানির বিষয়ে অধিকতর তদন্তের লক্ষ্যে বেশ কিছু টার্মস অব রেফারেন্স নির্ধারণ করে কমিশন। এ লক্ষ্যে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ ও রুকসানা চৌধুরীর সমন্বয়ে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত কমিটি ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ সব কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের মাসিক বিবৃতি, পরিচালক ও উদ্যোক্তাদের ঘোষণাকৃত শেয়ার লেনদেনের মাসিক বিবৃতি, সন্দেহজনক লেনদেন, গুজবভিত্তিক লেনদেন, অনৈতিক লেনদেনের তথ্য এবং ওয়েবসাইটে ঘোষিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে সংগ্রহ করে।

প্রাপ্ত তথ্য এবং কোম্পানির প্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্যেরভিত্তিতে শেয়ার দর উঠানামা করে কোনো সুবিধাভোগী মহল আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে কিনা কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে। কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনার পাশাপাশি ঘোষণা ছাড়া অথবা ঘোষণা দিয়ে উদ্যোক্তা-পরিচালকরা সিকিউরিটিজ কেনা-বেচা করেছেন কিনা তাও পর্যালোচনা করে কমিটি।

একই সঙ্গে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বা সরাসরি তালিকাভুক্তির জন্য বিএসইসির কাছে জমা দেওয়া প্রসপেক্টাসে উল্লিখিত তথ্যাবলি যাচাই-বাছাই করা হয়।

এ ছাড়া ওয়ারেন্ট ইস্যু, অগ্রাধিকার শেয়ার ইস্যু, পরিচালকদের ঋণের বিপরীতে শেয়ার ইস্যুর কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়। পর্যালোচনা করা হয় শেয়ার দরের অস্বাভাবিক উঠা-নামা এবং লেনদেন। পাশাপাশি কোম্পানি কর্তৃক সিকিউরিটিজ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান পরিপালন না করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের কার্যক্রম ও ভূমিকাও পর্যালোচনা করে কমিটি। সব প্রক্রিয়া শেষে এই ১৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে অধ্যাদেশের ১৭ ধারা লঙ্ঘনের প্রমাণ পায় অধিকতর তদন্ত কমিটি।

এ বিষয়ে বিএসইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে ১৭ কোম্পানির কেস স্টাডিসহ অন্য বিষয়ের ওপর অধিকতর তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করেছে। কমিশন সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এনফোর্সমেন্ট বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে। এনফোর্সমেন্ট বিভাগ অভিযুক্তদের শুনানিতে তলব করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’

এদিকে, বিএসইসির সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করেন সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শাস্তি নির্ভর করবে লঙ্ঘিত আইনের ওপর। এক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনের লঙ্ঘন হলেও মামলা জটের অজুহাতে সিকিউরিটিজ আইনের আওতায় জরিমানা করা সঠিক হবে না।’

অপরদিকে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বিএসইসির সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পুঁজিবাজার ধ্বংসের কারণে বিনিয়োগকারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই কারও বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা অবশ্যই আর্থিকভাবে হওয়া উচিত। যারা কারসাজি করেছে তারা তো মানুষ খুন করেনি যে ফৌজদারি আইনের আওতায় শাস্তি দিতে হবে। তারা যেহেতু ফিনান্সিয়াল ক্রাইম করেছে সেজন্য তাদের আর্থিক দণ্ড দিতে হবে। তবে কেউ ৫০ লাখ টাকা অবৈধভাবে অর্জন করলে, তাকে শাস্তিস্বরূপ ৫ অথবা ১০ লাখ টাকা যাতে জরিমানা করা না হয় সে বিষয়ে বিএসইসিকে খেয়াল রাখতে হবে। দোষীকে অবশ্যই অবৈধ উপার্জনের অধিক অথবা দেড় থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ জরিমানা করতে হবে। আদায়কৃত অর্থ বিএসইসির কোষাগারে না রেখে ওই সময় যে সব বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া উচিত।’

জানতে চাইলে খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা। তা শেষ করে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। এখন এ বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সেটা বিএসইসির বিষয়। এতে আমার বলার কিছুই নেই।’

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/এইচকে/এমডি/আরকে/জানুয়ারি ১১, ২০১৪)