জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিয়ে বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি বিরোধী দলেও থাকছে। আবার মন্ত্রীত্বও নিচ্ছে। তবে দলগুলোর মধ্যে একাংশ বিরোধী দলের ভূমিকা নিতে চাইছে।

অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে দেখা দিয়েছে বিরোধ। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও জোটের প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ায় এই বিরোধ দেখা দিয়েছে।

জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের একাধিক সূত্র দ্য রিপোর্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এ সব দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওয়ার্কার্স পার্টির ৬ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে দুইজন দলীয় প্রতীক হাতুড়ি নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ৪ জন।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)এর ৩ জন নির্বাচিত হয়েছেন জোটের নৌকার যাত্রী হয়ে। অপর দুইজন হয়েছেন দলীয় প্রতীক মশালে।

তাই দল দু’টির অধিকাংশ সংসদ সদস্য নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হওয়ায় বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারছেন না।

তবে দল দুইটির দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বিরোধী দলের ভূমিকায় যেতে চাইছেন।

নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ভোটগ্রহণের পর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতরাসহ সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ ২৩২টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ৩৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৫, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনএফ) ১, জাতীয় পার্টি (জেপি) ১ (বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়), তরিকত ফেডারেশন নৌকা প্রতীকে ১টি আসনে জয় লাভ করে। সেই সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন ১৩টি আসনে।

সংসদের বিধি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবেন এবং নিকটতম সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিরোধী দল হবে। তবে বিরোধীদের অবশ্যই কমপক্ষে ৩০ জন সংসদ সদস্য থাকতে হবে। যা ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ কারও নেই। কিন্তু জাতীয় পার্টির ৩৩ জন সংসদ সদস্য থাকলেও বিরোধী দলের ভূমিকায় যাওয়া না যাওয়া, মন্ত্রীত্ব গ্রহণ নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে দলটির সংসদ সদস্যরা।

বাংলাদেশের সরকারগুলোর রূপরেখা থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টি জেপি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করেছিল। তবে ওই সরকারের বিরোধী দল ছিল বিএনপি।

এ বিষয়ে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও শ্রম-কর্ম-পেশায় নিয়োজিত সমাজশক্তিসমূহের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার হতে পারে। তবে ‘যাহাই লাউ তাহাকেই কদু’ বানানোর চেষ্টা করছে সরকার। মহাজোটকে জাতীয় ঐক্যের সরকার বানানোর চেষ্টা করছেন। যেভাবে তারা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করেছিল সেইভাবেই তারা মহাজোটকে জাতীয় সরকার বানানোর চেষ্টা করছেন।

জাতীয় পার্টির অধিকাংশ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচনকালীন মন্ত্রী সভায় স্থান পাওয়া নেতাদের ইচ্ছা হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের সরকারের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন জাতীয় পার্টির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও। তবে দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদের সিদ্ধান্ত শুধু বিরোধী দলে থাকা।

এ বিষয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জাতীয় পার্টি থেকে কাউকে মন্ত্রী না বানানোর শর্ত দিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদেরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে রিসিভ করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। তিনি জিএম কাদেরের বরাত দিয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, এ বিষয়ে স্যার কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তবে আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমরা যা জানতে পেরেছি তিনি বিরোধী দলেই থাকতে চান।

জাতীয় পার্টির অপর একটি সূত্র জানায়, পার্টির চেয়ারম্যান না থাকায় এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ছাড়া কতজন সদস্যকে তারা মন্ত্রী সভায় রাখতে পারবেন এ নিয়ে আওয়ামী লীগেরও সংশয় আছে। বিরোধী দল কিংবা সরকারি দলে থাকা নিয়ে এখন পর্যন্ত স্যারের (এরশাদ) মতামত জানা যায়নি।

এদিকে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা করে গেজেট প্রকাশ করেছে সংসদ সচিবালয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মাহজাবীন মোরশেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, বিরোধী দলে যাওয়া কিংবা জাতীয় ঐক্যের সরকারের মন্ত্রীত্ব গ্রহণের বিষয়ে আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও পার্টির সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ সিদ্ধান্ত নেবেন। উনারা যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা সেই সিদ্ধান্তেই চলব।

তবে ভিন্ন কথা বলেন জাতীয় পার্টির অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, বিরোধী দল থেকে সরকারি দলে থাকা যাবে না। এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা সরকারি ও বিরোধী দুই দলেই থাকতে চাই।

বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে খোদ আওয়ামী লীগেও। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দ্য রিপোর্টকে বলেন, বিরোধী দল থেকে মন্ত্রীত্ব দিতে সাংবিধানিক বাধা নেই, জাতীয় সরকারও হতে পারে বিরোধী দলবিহীন।

তবে শনিবার রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, এক দলের মাথা, অন্য দলের লেজে সরকার হয় না। বিরোধী দলকে টোটাল বিরোধী দল হতে হয়। অবশ্য পাকিস্তান আমলে একবার রেসপন্সিভ বিরোধী দলের দেখা আমরা পেয়েছি। কিন্তু আধা-আধি বিরোধী দলের জায়গা নেই।

সুরঞ্জিত বলেন, নতুন একটি কাঠামোতে নির্বাচন ও সরকার গঠন হচ্ছে। এ সব বিষয় নিয়ে কিছু আলোচনা থাকবেই। দ্বিতীয়বার আর আলোচনা থাকবে না। কারণ তখন মানুষের কাছে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

একইসঙ্গে বিরোধী দল ও সরকারে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা গণতন্ত্রের রীতিবিরুদ্ধ। দেলোয়ার বনাম রাষ্ট্র মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এভাবে একইসঙ্গে বিরোধী দল ও সরকারে থাকা অনৈতিক ও সংসদীয় রাজনীতির রীতি বিরুদ্ধ। বিরোধী দলকে রাজপথে থেকে প্রমাণ করতে হবে তারা প্রকৃত বিরোধী দল। শুধু সংসদে বিরোধী দলের তকমা নিয়ে থাকলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না।

তবে জাতীয় পার্টি থেকে ৩ জনকে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হতে পারে বলে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রে জানা যায়। বিরোধী দল থেকে মন্ত্রী দেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কখনও ঘটেনি। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের ব্যাখ্যা হচ্ছে মন্ত্রী বানানোর সকল এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে মন্ত্রী বানাবেন কাকে বানাবেন না। এ বিষয়ে সংবিধানের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

(দ্য রিপোর্ট/এইউএ/এসবি/সা/জানুয়ারি ১১, ২০১৪)