রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থছাড়ে জটিলতার আশঙ্কা
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থছাড়ে জটিলতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি চিঠি দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের (২০১৩-১৪) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ করা অর্থ হতে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রথম ও চতুর্থ কিস্তির অর্থ অবমুক্ত করা জরুরি প্রয়োজন। এ জন্য কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সম্মতি চাওয়া হয়েছে।
কিন্তু চিঠি দেওয়ার পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও সম্মতি দেয়নি পরিকল্পনা কমিশন। কবে নাগাদ এ সম্মতি দেওয়া হবে সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবদুল মান্নান হাওলাদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, অর্থছাড়ের সম্মতির বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান হলেই সম্মতি দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সহকারী প্রধান শাহাদৎ হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন পরমাণু শক্তি কমিশন কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন (১ম পর্যায়) প্রকল্পের অনুকূলে চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় রাশিয়ান ফেডারেশনের নির্ধারিত ঠিকাদার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট-এর সঙ্গে ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চুক্তি মূল্যের ১০ শতাংশ হিসেবে মোট চুক্তিকৃত অর্থের সমপরিমাণ স্থানীয় টাকায় প্রতি মার্কিন ডলার ৮০ টাকা হিসেবে মোট ২১৭ কোটি টাকা রাশিয়ান ফেডারেশনকে দেওয়ার কথা। এ টাকা চুক্তি স্বাক্ষরের ৬০ দিনের মধ্যে অগ্রিম পরিশোধ করার নিয়ম রয়েছে। এ জন্য প্রকল্পটির অনুকূলে ২১৭ কোটি টাকা দ্রুত অবমুক্তির সম্মতির জন্য পরিকল্পনা কমিশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় ৭০দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও সম্মতি দেয়নি পরিকল্পনা কমিশন।
সূত্র জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রাশিয়ার আর্থিক সহায়তায় প্রথম পর্যায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ অংশের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে ১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা এবং রাশিয়ার স্টেট ক্রেডিট থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য পাবনার রূপপুরে ১৯৬১ সালে ২৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তীতে ওই স্থানে আবাসিক ভবন সাইট অফিস, রেস্ট হাউজ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, পাম্প হাউস ইত্যাদি নির্মাণও করা হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৮-৭৯ সালে সরকার বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় । এ জন্য একটি সম্ভাব্যতা জরিপ করা হয়। জরিপে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের জন্য যথার্থ এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এ জন্য ১৯৮০ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১২৫ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থায়নসহ অন্যান্য সমস্যার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে এ প্রকল্পের একটি ফলোআপ স্টাডি করা হয়। এ স্টাডিতেও প্রকল্পটি কারিগরি এবং আর্থিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য বলে সুপারিশ করা হয়। তারপর ওই অবস্থায়ই প্রকল্পটি ফাইলবন্দি হয়ে ছিল।
এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ নেয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদান ও বাস্তবায়ন কার্যাবলী মনিটরিংয়ের জন্য ২০১০ সালের ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বিষয়ক একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়।
এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অর্থায়নের উৎসসমূহ চিহ্নিতকরণ, অর্থায়নে প্রয়োজনীয় শর্তাদি নির্ধারণ, সম্ভাব্য প্রযুক্তি ও সরবরাহকারী চিহ্নিতকরণের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কারিগরি কমিটি এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ভৌত, কারিগরি ও অন্যান্য বিষয়ে প্রতিবেদন প্রণয়ন কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপসহ কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ইন্টারন্যাশনাল এ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) এবং প্রযুক্তিসহ সরবরাহকারী দেশ রাশিয়ান ফেডারেশনের সহায়তা প্রাপ্তির জন্য ইতিমধ্যে প্রকল্প এলাকার প্রাথমিক পর্যায়ের সেফটি সংক্রান্ত স্টাডি সার্ভে সম্পাদন করা হয়েছে।
আইএইএ পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে এবং এ সংক্রান্ত ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা চিহ্নিত করেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ও রাশিয়ান ফেডারেশন রূপপুর প্রকল্প এলাকায় দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ ইউনিট নির্মাণের লক্ষ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনর্গঠন সহযোগিতা বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
প্রথম পর্যায়ে এ প্রকল্পের আওতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে সাইট সংশ্লিষ্ট ডিজাইন প্যারামিটার ও টেকনো-ইকোনমিক সলিউশন নির্ধারণ, প্রয়োজনীয় ডিজাইন ডকুমেন্টেশন তৈরি, প্রস্ততিমূলক অপরিহার্য নির্মাণ কার্যক্রম সম্পাদন, মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজের জন্য রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আর্থিক চুক্তিসমূহ সম্পাদন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরমাণু প্রযুক্তি বিষয়ে যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং প্রকল্প সাইট ও প্রকল্প সাইট অফিস এবং আবাসিক এলাকার ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে বলে জানা গেছে।
(দ্য রিপোর্ট/জেজে/জেএম/ এনআই/জানুয়ারি ১১, ২০১৪)