বিচারপতি হাবিবুর রহমান আর নেই
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান আর নেই (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)।
রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার শাহীনুর রহমান শনিবার রাত সোয়া ৯টায় মৃত্যু নিশ্চিত করেন বলে জানান তার স্ত্রী ইসলামা রহমান। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
স্ত্রী ও বড় মেয়ে রুবাবা রহমানকে নিয়ে হাবিবুর রহমান গুলশান-১ এর ১২৪ নম্বর রোডের ৭/এ বাসার তিন তলাতে থাকতেন। ছোট দুই মেয়ে নুসরাত হাবিব ও রওনাক শিরীন আমেরিকায় থাকেন।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শনিবার রাত সোয়া ৮টায় রাতের খাবার শেষে তিনি শোবার ঘরে ছিলেন। সাড়ে ৮টার দিকে গৃহকর্মী সূচনা ঘরে ঢুকে দেখেন তিনি বিছানার নিচে পড়ে আছেন। এরপর দ্রুত ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তিনি আগেই মারা গেছেন।
গৃহকর্মী সূচনা বেগম বলেন, ‘আমি স্যারের ঘরে ঢুকে দেখি তিনি বিছানার নিচে পড়ে আছেন। মুখ দিয়ে লালা বের হচ্ছে। আমি চিৎকার দিলে সবাই আসে। তখন তিনি কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। তার কোনো অসুখ ছিলো না। প্রতিদিন সকালে নামাজের পর তিনি হাঁটতে যেতেন। আজকেও (শনিবার) সকালে হাঁটতে বের হয়েছিলেন।’
তার স্ত্রী বলেন, ‘সারাদিন তিনি সুস্থ ছিলেন। সকালে মিডিয়ার লোকজন এসে তার সঙ্গে কথা বলেন। আর আমার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল ৮টার দিকে। এভাবে তিনি চলে যাবেন ভাবতে পারিনি।’
হাবিবুর রহমানের শ্যালক ইফতিয়ার চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাবিবুর রহমানের মরদেহ সোমবার সকাল পর্যন্ত হাসপাতালেই থাকবে। তার ছোট মেয়ে নুসরাত হাবিব আমাকে জানিয়েছেন সোমবার সকালে সে ঢাকায় পোঁছাবে। এরপর হাসপাতাল থেকে মরদেহ সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হবে। তারপর বাদ আছর গুলশানের আজাদ মসজিদে জানাজা পড়ানোর পর বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
হাবিবুর রহমানের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হাবিবুর রহমানের মৃত্যুতে জাতি একজন দৃঢ়চেতা ব্যাক্তিত্ব, অসাধারণ বিচারিক বুদ্ধিসম্পন্ন বিচারক ও রবীন্দ্র অনুরাগী জ্ঞানী ব্যাক্তিকে হারাল। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় হাবিবুর রহমানের অসামান্য অবদান আগামী দিনের বাংলাদেশ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি একজন সৎ, বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও দেশপ্রেমিক এক মহান ব্যাক্তিকে হারিয়েছে। তার শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়।’
বিবৃতিতে তিনি বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন ও শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দেশের বিচার ব্যবস্থায় তার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবেও সাহসী দায়িত্ব পালনের জন্য জাতি তার প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবে।’
তার মৃত্যুর খবর শুনে রাত ১১টার দিকে হাসপাতালে আসেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ।
তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং বরেণ্য ব্যক্তি। সত্যিকার অর্থে আজ আমরা দেশের একজন কৃতী সন্তানকে হারালাম। তিনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থাকার সময় তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তিনি সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছেন।’
আবুল মকসুদ বলেন, ‘তিনি আমাদের সঙ্গে মনে হয় পরিহাস করলেন। আমি বলব তিনি নাটকীয়ভাবেই চলে গেলেন। দেশের এমন সঙ্কটময় সময়ে আমরা একজন অভিভাবককে হারালাম। দেশের গণতন্ত্রের উত্তরণে তার যে অবদান তা জাতির কাছে স্মরনীয় হয়ে থাকবে।’
সংক্ষিপ্ত জীবনী
১৯৯৫ সালে হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হিসেবে তিনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তথা দেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি একাধারে গবেষক, লেখক, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, অভিধানপ্রণেতা। ১৯৪৯-৫২ এর ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯২৮ সালে ৩ ডিসেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার জংগীপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে মুহম্মদ হাবিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন৷ বাবা মৌলভী জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন আইনজীবী৷ জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। তিনি প্রথমে আঞ্জুমান এবং পরে মুসলিম লীগ আন্দোলনের সাংগঠনিক পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হাবিবুর রহমানের পিতা জাতীয় যুদ্ধ ফ্রন্টের বিভাগীয় নেতা ছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর মাসে তাকে গ্রেফতার করে বহরমপুর কারাগারে পাঠায়, অবশ্য কয়েকদিন পরই জহিরউদ্দিন বিশ্বাস মুক্তি লাভ করেন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে মুশির্দাবাদ ছেড়ে জহিরউদ্দিন বিশ্বাস রাজশাহীতে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন৷ হাবিবুর রহমানের মা গুল হাবিবা ছিলেন গৃহিণী৷
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে ১৯৪৯ সালে বিএ সম্মান ও ১৯৫১ সালে এমএ পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে ১৯৫৮সালে বিএ সম্মান ও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
হাবিবুর রহমান তার কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে তিনি ইতিহাসের রিডার (১৯৬২-৬৪) ও আইন বিভাগের ডিন (১৯৬১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আইন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ঢাকা হাই কোর্ট বারে যোগ দেন। তিনি সহকারী এডভোকেট জেনারেল (১৯৬৯), হাই কোর্ট বার এসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট (১৯৭২) ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলেরও (১৯৭২) সদস্য ছিলেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫সালে পর্যন্ত তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি ১৯৯৫ পর্যন্ত আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।। ১৯৯০-৯১ মেয়াদে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে হাবিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত বিচাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
(দ্য রিপোর্ট/এআইএম/এমসি/জানুয়ারি ১২, ২০১৪)