দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নাশকায় প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক সাধারণ মানুষ। ২৮ নভেম্বর শাহবাগে একটি বাসে নাশকতাকারীরা পেট্রোল বোমা ছুঁড়লে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন ব্যাংক কর্মকর্তা মাসুমা আক্তার। ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই কর্মজীবী নারী। পরীবাগে বাসে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান আরেক বীমা কর্মকর্তা শাহিনা আক্তার ও সবজি ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়া।

শুক্রবার অবরোধ নেই এই চিন্তা করে গ্রামের বাড়ি খুলনার উদ্দেশে বের হন শাহিনা। নাশকতাকারীদের আগুনে আর ঘরে ফেরা হলো না মাসুমা, শাহিনাদের। সন্তানের কাছে ফেরা হলো না ফরিদ মিয়ার মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর।

সম্প্রতি রাজনৈতিক নাশকতায় ঘটে যাওয়া এ সব ঘটনায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন কর্মজীবী নারী ও খেটে খাওয়া মাসুষগুলো।

সন্তানের মুখ দেখে বাসা থেকে বের হলেও, কাজ শেষে প্রিয় সন্তানের কাছে ফিরতে পারবেন কি না এমন সংশয় কর্মজীবী নারীদের।

এমনি একজন কর্মজীবী নারী নাসরিন সুলতানা লিনা। তার সংশয়, কবে জানি তার একমাত্র সন্তানটি মা হারা হয়।

ঢাকার দোহারে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নাসরিন সুলতানা লিনা। স্বামী ও তিন বছর বয়সী এক সন্তান নিয়ে থাকেন মোহাম্মদপুর চাঁন মিয়া হাউজিংয়ে। স্বামী একটি বেসরকারি অফিসের ম্যানেজার। প্রতিদিন মোহাম্মদপুর থেকে গুলিস্তান হয়ে তারপর নাসরিন সুলতানাকে যেতে হয় নিজের কর্মস্থল দোহারে। আগে সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই কর্মস্থলে যেতেন তিনি। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতায় একাই বের হন বাসা থেকে। সন্তানের দেখাশোনার সমস্যা হওয়ায় গ্রামের বাড়ি পাবনা থেকে এক আত্মীয়াকে নিয়ে এসেছেন তিনি।

সম্প্রতি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জীবন-যাপন সম্পর্কে জানতে চাইলে নাসরিন সুলতানা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমার প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটি ৫ বছরের। আগে পাবনাতেই ছিলাম। কিন্তু স্বামী ঢাকাতে থাকায় ট্রান্সফার করে ঢাকাতে এসেছি। এক বছর হলো আমি ঢাকাতে আছি। ছয় মাস আগেও আমি স্কুলে আসা-যাওয়ার ব্যাপারে চিন্তিত ছিলাম না। বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়েই স্কুলে যেতাম। কিন্তু দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে রাস্তায় চলাফেরা করা খুবই রিস্ক। যেভাবে গাড়িতে, বাসে আগুন দেওয়া হচ্ছে, এগুলোতে দেখে খুবই ভয় হয়। এ সব দেখে এখন আর বাচ্চাকে নিয়ে বের হইনা। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের হই। যদি কিছু হয় তাহলে আমারই হোক, বাচ্চাটি বেঁচে থাকুক। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ভাবি, বাচ্চাটাকে আর দেখতে পাবো কিনা। টিভিতে যখন দেখি আমার মতো একজন কর্মজীবী নারী বাসের আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে, তখন ভাবি আমার সন্তানটিও কি এমনভাবে মা হারা হবে?’

নাসরিন আক্তারের প্রশ্ন-আমরা তো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী না, তাহলে আমাদের কেনো পুড়ে মরতে হবে? আমাদের নিরাপত্তা কে দিবে?

একটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সাঈদ আহমেদ রাসেল দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জীবনটাকে হাতে নিয়ে প্রতিদিন রাস্তায় বের হই। ঘর থেকে বের হলেই মনে হয় বাসে চড়বো না, পেট্রোল বোমা মারতে পারে। তাই প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়া করি রিকশায় করে। অনেক খরচ হয় তারপরও অন্তত জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চলাফেরা করি।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন গ্রাম থেকে বাবা-মা বারবার ফোন করে, অফিসে পৌঁছেছি কিনা। অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি কিনা। সাবধানে চলাফেরা করতে বলেন। বুঝি তারা অনেক টেনশনে থাকেন।’

বেসরকারি এই চাকরিজীবী বলেন, সরকার জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। রাস্তায় যেভাবে ককটেল আর পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, সেগুলো বন্ধ করতে পারছে না। বাসে আগুনের ঘটনায় বিএনপির নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। শুধু তাদের কেনো গ্রেফতার করা হবে? এ সব ঘটনায় সরাসরি যারা জড়িত তাদের কেনো পুলিশ শনাক্ত করতে পারছে না? কেনো ঘটনাগুলোর পরিকল্পনার করার সময় তাদের ধরতে পারছে না?

মানুষ মারার দায় এক দল আরেক দলের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বিরোধী দল বলছে, তারা এগুলো করছে না। কিন্তু তাদের হরতাল-অবরোধেই তো এগুলো ঘটছে। বিএনপি হরতাল-অবরোধ বন্ধ করে দিক, তখন যদি এগুলো ঘটে তাহলে বোঝা যাবে এগুলো কারা করছে।’

মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম মোল্যার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ের কাজে আমাকে নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় যেতে হয় কাপড় কেনার জন্য। কিন্তু টানা অবরোধে দোকানে নতুন কোনো মাল তুলতে পারছি না। শুক্র-শনিবার অবরোধ না থাকলেও গাড়িতে আগুন দেওয়া তো বন্ধ নেই। সেদিন টিভিতে দেখলাম ট্রাকে করে গরু নিয়ে যাচ্ছে সেই গাড়িতে আগুন দিয়েছে। কোথায় যেন টমেটো বোঝায় ট্রাকেও আগুন দেওয়া হয়েছে। এতো কিছু দেখে সাহস পাই না বের হতে।’

নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ভোটের আগে অবরোধ হরতাল ছিলো। ভোট তো হয়ে গেছে, এগুলো কি বন্ধ হয়েছে। এখন আরো ভয় বেশি লাগে। বিএনপির দাবিতো সরকার মেনে নেয়নি। তাহলে তারাও তো আগের চাইতে বেশি মারামারি করবে।’

তিনি বলেন, ‘এই অবরোধের মধ্যেও দুই এক বার নারায়ণগঞ্জ গেছি কাপড় আনতে। বিশ্বাস করুন মন টানছিলো না, শুধুমাত্র ব্যবসার কথা চিন্তা করে গেছি। ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে সংসার চলবে কিভাবে।’

(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এসবি/ এনআই/জানুয়ারি ১১, ২০১৪)