কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা-গ্রেফতার ছিল সাজানো!
নেতাদের আঁতাতের মাসুল দিচ্ছে বিএনপি
তারেক সালমান ও মাহমুদুল হাসান, দ্য রিপোর্ট : ব্যাপক জনসমর্থন ও সাধারণ তৃণমূলকর্মীদের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও সরকারবিরোধী আন্দোলনে একের পর এক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। আওয়ামী মহাজোট সরকারের শাসনামলে একটি আন্দোলনেও সফলতা দেখাতে পারেনি স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় দেশের শাসনভারের দায়িত্ব পালনকারী এই দলটি। আন্দোলন যখন তুঙ্গে সে সময়েও সরকারের নানা চাপ ও কৌশলের কাছে বার বার ‘ধরা’ খেয়ে ‘ব্যাকফুটে’ চলে গেছে দলটি। সে কারণে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে সরকার গঠন করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি আওয়ামী লীগকে।
তবে কেউ কেউ বলেছেন বিএনপির কৌশলের কাছে বরং হেরে গেছে সরকার। একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করার মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক ইমেজ হারিয়েছে। এই ইমেজ নিয়ে খুব বেশি পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হবে না বলেও মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহল। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. শামসুজ্জামান দুদু দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলন ১০০ ভাগ সফল হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে বিএনপি যে আন্দোলন, তার যৌক্তিকতা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের জনগণ ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে প্রমাণ করেছে।’
দুদু বলেন, ভোটারবিহীন নির্বাচনে তারা (সরকার) লটুপাট, ডাকাতি করে ও জাল ভোট দিয়ে কলঙ্কিত নির্বাচনের ইতিহাস তৈরি করেছে। একটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় ৫০০ লোক মারা গেছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও ঘটেনি।
দুদু আরও বলেন, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মুখে ১৮ দলের নেতাকর্মীরা নিরস্ত্র আন্দোলন করে যাচ্ছে।
বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির এক প্রবীণ সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য রিপোর্টকে বলেন, আন্দোলনে জনসমর্থন ও কর্মীর কোনো অভাব নেই বিএনপির। কিন্তু তাদের সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে এক সুতায় গেঁথে আন্দোলনের লক্ষ স্থির করে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তাদের রাজপথে নামিয়ে দিয়ে, সরকারের পেটোয়া বাহিনীর গুলির মুখে ঠেলে দিয়ে, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের শিকারে পরিণত করে আমরা থেকেছি আরাম-আয়েসে। এটা অবশ্যই সাধারণ নেতাকর্মীদের সঙ্গে বেঈমানী।
ওই নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নিজেদের কোটি কোটি টাকা ও সম্পদ রক্ষার জন্য সদা ব্যতিব্যস্ত থেকেছেন। সে কারণে আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে পর্দার আড়ালে সরকারের সঙ্গে আঁতাতে ব্যস্ত থেকেছেন। কীভাবে আন্দোলনে সফল হবে বলুন?’
এদিকে আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত করা শুরু করেছে বিএনপি। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া তার বিশ্বস্ত কয়েক নেতাকে গোপনে এ ব্যাপারে একটি ‘নিরপেক্ষ ও নির্মোহ’ কেসস্টাডি করার দায়িত্ব দিয়েছেন। বিএনপি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। রিপোর্ট খালেদা জিয়ার হাতে পৌঁছানোর পর এ ব্যাপারে তিনি তার অন্য বিশ্বস্ত লোকদের দিয়ে পুনরায় যাচাই-বাছাই করবেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছাড়াও লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দল, দলের সাংগঠনিক প্রকৃত চিত্র ও ব্যর্থ নেতাদের বিষয়ে নিজস্ব বলয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে তারেক তার সাবেক কয়েকজন ‘প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী’ সহযোগী এমনকি তার ব্যক্তিগত স্টাফদেরও তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যেই তার হাতে কিছু তথ্য এ সব লোক বিভিন্ন মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন। যার আলোকে তিনি যাচাই-বাছাই করে এদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ও সচেতন থাকতে মা খালেদা জিয়াকেও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
তারেকের নিজস্ব অনুসন্ধানের ব্যাপারে দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে যুক্তরাজ্য বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা জানান, পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হাতে না পেলেও দলের সাংগঠনিক ‘পোস্টমর্টেম’ ও নেতাদের দলীয় আনুগত্য সম্পর্কে কিছু চিত্র দেখে তারেক রহমান রীতিমত অবাক হয়েছেন। আংশিক চিত্র দেখেই তিনি ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত। চিত্রে ধরা পড়েছে, তৃণমূল থেকে রাজনীতি না করেই অনেকেই দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে বহাল হয়েছেন। যাদের অধিকাংশেরই নিজের জেলা, উপজেলা বা নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গেও ভালো যোগাযোগ নেই। তারা মূলত বিগত ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের সময় অনৈতিক পন্থায় ও লেন-দেনের মাধ্যমে এ সব গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন। টাকার বিনিময়ে নেতা হয়ে এই সব নেতাই দলের কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বা এ সব কর্মসূচিতে নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে কোনো চেষ্টা বা আন্তরিকতার আশ্রয় নেননি। যার কারণে কেন্দ্রের হাজারও কর্মসূচি দীর্ঘ সময়েও তৃণমূলকে এক সুতায় গাঁথতে পারেনি।
সূত্র আরও জানায়, ২০০৯ সালের কাউন্সিলে অনেক যোগ্য, ত্যাগী নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন সুবিধাভোগী ও অযোগ্যদের ভিড়ে। ব্যক্তিগত লবিংয়ের মাধ্যমে এ সব অনেক অযোগ্য সুবিধাভোগী নেতা দুই থেকে তিনটি পদে নিজেদের অলঙ্কৃত করেছেন। এ ছাড়া, অঙ্গ সংগঠনের প্রধান প্রধান নেতা কমিটি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে দলীয় ফোরামে।
বিএনপির আরেকটি সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির অনেক নেতাও সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে চলেন এমন অভিযোগ সম্পর্কে বিএনপির চেয়ারপারসন জানতে পেরেছেন। দেশীয় রাজনীতিতে আন্দোলন-সংগ্রামের পীঠস্থান ঢাকা মহানগর নেতারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে রাজনীতি করছেন, বিএনপিতে এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার সে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন দলীয় হাইকমান্ড। অভিযোগ রয়েছে ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক, সদস্য সচিবসহ বেশ কয়েকজন যুগ্ম আহ্বায়ক বিএনপির প্রতি যতটা না অনুগত তার চেয়ে বেশি তারা সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে এসেছেন। এ কারণে তাদের কারসাজিতেই আন্দোলন সারাদেশে তুঙ্গে উঠলেও ঢাকাতে মুখথুবড়ে পড়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, গত বছরের ১২ মার্চে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের নজিরবিহীন হামলা, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাসহ দলের ১৫৩ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের বিষয়টিও নেতাদের সাজানো ও সমঝোতা ছিল বলে দলের হাইকমান্ড জানতে পেরেছেন। নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের (আরপিও) বাধ্যবাধকতার কারণে ওই সময় বিএনপি জাতীয় কাউন্সিল করার লক্ষে অগ্রসর হচ্ছিল। আর দলের কাউন্সিলকে সামনে রেখেই দলীয় কার্যালয়ে পুলিশের হামলা, গুলি ও অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পুলিশ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে নেতাদের গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে দলের বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, কাউন্সিলে অংশগ্রহণকারী সারাদেশের নেতাদের জন্য তৈরি পরিচয়পত্র নিয়ে যায় বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। এ ঘটনার পর দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে কাউন্সিলের সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়। এরপর দলের জাতীয় কাউন্সিল আজও হয়নি।
দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে থাকেন, যে সব নেতার দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি হারানোর ভয় ছিল, ওই হামলায় ও অফিস থেকে গণহারে গ্রেফতারের পেছনে সরকারের সঙ্গে তাদের হাত ছিল। তাদের অভিমত, হামলা ও গণগ্রেফতারের উদ্দেশ্য ছিল আহূত কাউন্সিল বাতিল করা। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
সরকারের সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের আঁতাত থাকার কারণে সরকার এককভাবে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েছে- এমন প্রচারণা প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. শামসুজ্জামান দুদু বলেন, না, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এটি সরকারের পক্ষের লোকদেরই ষড়যন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এ রকম ষড়যন্ত্র হয়েছিলো। যে কারণে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর জয় পায় বাংলাদেশ। এই সরকার মানার কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে দুদু বলেন, ‘স্বৈরাচার, গণবিরোধী সব কাজই এ সরকার করছে। যেখানে জনগণের চাওয়া তুচ্ছ। এই সরকার মানলে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা হবে। কারণ তারা হানাদার বাহিনীর চেয়েও বর্বর কাজ করছে। জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জয় হবে। একটু সময় লাগবে। তা ছাড়া কোনো স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে কেবল বিএনপিই নয়, যে কোনো সময় যে কেউ রুখে দাঁড়াতে পারে।’
(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/এসবি/ এনআই/এইচএসএম/জানুয়ারি ১২, ২০১৪)