ইসহাক ফারুকী, দ্য রিপোর্ট : নাট্যচার্য সেলিম আল দীনের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী মঙ্গলবার। রাজধানীর কল্যাণপুরে সেলিম আল দীনের একজন বন্ধু থাকেন। তার উদ্দেশে যাওয়া; যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাসার দরজার কড়া নাড়তেই সুঠাম দেহের যে প্রবীণ ব্যক্তিটি বেরিয়ে এলেন তিনি আতিকুল ইসলাম। ইনি সেলিম আল দীনের সহপাঠী ছিলেন। পরিচয়পর্ব শেষে বাসার ভেতরে বসে চলে দীর্ঘ আলাপচারিতা।

আতিকুল ইসলামের আরেকটি পরিচয় তিনি বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানান, ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ভর্তি হন। থাকতেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলের (বর্তমান সূর্য সেন হল) সাউথ হাউসে। মঞ্চ নাটক, পড়ালেখা, রাজনীতি ও আড্ডায় মুখর ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে সে সময় সেলিম আল দীনের সখ্য গড়ে ওঠে।

আতিকুল ইসলাম বলেন, ’৬৭-৬৮ সালের কথা। আমরা আসকার ইবনে শাইখ, বিধায়ক ভট্টাচার্য, কল্যাণ মিত্র, মুনীর চৌধুরীর নাটক করি। তখন তুমুল নাট্য আন্দোলন চলছে। আব্দুল্লাহ আল মামুন, নাজমুল হুদা বাচ্চুরাও এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আসকার ইবনে শাইখের নির্দেশনায় নাট্যচর্চা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের তিনতলায় নাটকের মহড়া করতাম, দায়িত্ব সব বাচ্চু ভাইয়ের (নাজমুল হুদা বাচ্চু) হাতে। সেলিম তখন নাটক করত না। মহড়া থেকে বের হলেই ওকে দেখতাম- দাঁড়িয়ে আছে। আমরা বের হলেই ও বলত, তোরা এ সব কি নাটক করস? এ সব তো নাটকই না। তা হলে নাটক কোনগুলো জানতে চাইলে সে বলত, পরে জানবি। তখন আমাদের শিক্ষক মুনীর চৌধুরীকে আমরা অনেক মানি। তার নাটকও আমাদের কাছে বিশাল কিছু। মুনীর স্যারের ‘কবর’ নাটকটি নিয়ে সেলিম বলত, এটা কোনো নাটকই না। জিজ্ঞেস করতাম, তুই কোনো নাটক করিস না, পড়িস না, তুই নাটকের কী বুঝবি? ও বলত, সেটা পরে জানতে পারবি। আসলে তখন ও নিজের মধ্যে নিজেকে এতটা গুটিয়ে রেখেছিল যে, কেউ বুঝতে পারেনি, ওর মধ্যে কী ঘটছে?’

কথার ফাঁকে গরম গরম পুরি; পেঁয়াজু চলে এল। খেতে বললেন। এরপর ঋজু ভঙ্গিতে আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘সেলিম আল দীনকে আমরা তখন মূল্যায়ন করতে পারিনি। সেলিমের নাটক স্বাধীনতার পরেই প্রস্ফুটিত হয়। তাই আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা ছিল তার প্রস্তুতিকাল। একটা অন্তর্মুখিনতা কাজ করছিল তার মধ্যে। আপন জগতে বিচরণ করত সে। যেন কোনো কিছুকে ভেঙে নতুন কিছু তৈরি করার প্রত্যয় নিচ্ছে।’

এ কথাটুকু বলেই চুপ মেরে গেলেন আতিকুল ইসলাম। যেন পুরোনো বন্ধুকে মনে করে স্মৃতির পর্দাটা সরিয়ে নিচ্ছেন। হুট করে বললেন, ‘ও একটু অগোছালো ছিল। কখনও চুল আচড়াতে দেখিনি। কাঠপেন্সিল দিয়ে কাগজে কী সব লিখত। হয়ত নাটকের সংলাপ বা চরিত্র-কখনও প্রকাশ করেনি। এতটাই আনমনা ছিল যে, কেউ ডাকলে প্রথমবার সাড়া পেত না।’

জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা তো অনেক নামকরা শিক্ষক পেয়েছিলেন। উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা আসলে অনেক ভালো শিক্ষক পেয়েছি। আব্দুল হাই, আহমেদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, আনোয়ার পাশা, ওয়াকিল আহমেদ, নীলিমা ইব্রাহিম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মাহমুদা বেগম ও মুনীর চৌধুরী।’

এবার বললাম, ‘সেলিম স্যারকে নিয়ে আরও কিছু জানতে চাই।’ একগাল হেসে বললেন, ‘সে জন্যেই তো এসেছ। তাই না? শোনো, ১৯৬৮ সালের কথা। আমি তখন কল্যাণ মিত্রের কুয়াশা কান্না নাটকের মহড়ায়। বিকেল ৪টায় গুণ (কবি নির্মলেন্দু গুণ) আর হাসান (কবি আবুল হাসান) এসে বলল, দোস্ত মার্টিন লুথার কিং-কে তো মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা রেডিওতে শুনলাম। কথাটি শোনার পর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। জিন্নাহ হলের চায়ের দোকানে বসে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ‘মার্টিন লুথার কিং-কে কবিতাগুচ্ছ’ শিরোনামে বই বের করব। সেলিমও পাশে ছিল। সবাই মিলে কবিতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাকে সম্পাদক ও বেবী মওদুদকে প্রকাশক বানানো হল। ২ ঘণ্টার মধ্যে কবিতা লিখে ১০০ টাকা নিয়ে আমি, গুণ আর হাসান বাংলাবাজারে চলে গেলাম। তখন তো এত কিছু ছিল না। হ্যান্ড কম্পোজ করে ভোর চারটার মধ্যে ৫০০ কপি বই বের করলাম। সকাল আটটায় চেয়ারম্যান স্যারের (আব্দুল হাই) রুমে গেলাম। তার সামনে ছিল মর্নিং নিউজ। আমাদের বই দেখালাম। তিনি পত্রিকায় দেখলেন মার্টিন লুথার কিং নিহত, পাশে আমাদের বই। প্রচণ্ড অবাক হয়ে জানতে চাইলেন কীভাবে করলাম। সব ঘটনা বলার পর তিনি খুশি হয়ে আমাদের ১০ টাকা দিলেন।’ এ কথা বলার পর আতিকুল ইসলাম বললেন, ‘দেখ কী অবস্থা, সেলিমকে নিয়ে বলতে গিয়ে কত কী বলে ফেললাম।’

ঠিকই আছে এমন ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘উনার সঙ্গে কী নিয়ে বেশি আলোচনা হত?’ তিনি নড়েচড়ে বসলেন, ‘আমরা পড়াশোনা নিয়েই বেশি আলোচনা করতাম। কে কী বই পড়েছে, কতটুকু জেনেছি, এ সব আর কী? তা ছাড়া পারিবারিক বিষয়েও আলোচনা হত, তবে খুব কম। সে সব বিষয় নাই-বা বলি। তবে এটুকু বলতে পারি, আমার সঙ্গে যতটা না মিশত, অন্য অনেকের সঙ্গে সে সময় বেশি মিশতে দেখেছি ওকে। কেন মিশত, জানি না।’

বাঙালির আড্ডার অকৃত্রিম বন্ধু চা এল। কাপে চুমুক দিয়েই তিনি বললেন, ’৭৫ এর শেষের দিক। মহিলা সমিতিতে ওর সঙ্গে দেখা হল। আমাকে দেখেই বলল, আমি একটা দল করেছি। নাটক করছি। তুই আমার সঙ্গে কাজ করবি নাকি? আমি তখন বললাম, সে পাঠ অনেক আগেই চুকে গেছে বন্ধু। আমি এ সব থেকে সরে এসেছি। এরপর আরও অনেকবার দেখা হয়েছে। তবে নাটক দেখা, কথা বলা, এ সব আর কী?’

কাপের চা শেষ হতেই বললেন, ‘১৯৯৬-৯৭ সালের কথা। আমরা যারা ১৯৬৭-১৯৭১ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, তাদের নিয়ে একটি সংগঠন করি। ‘সতীর্থ ৬৭-৭১’ নাম দিয়েছিলাম। তখন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানে গেলাম। ওকে বললাম, সতীর্থ সম্মেলন করব। তুই থাকবি এখানে। ও রাজি হয়। যদিও দু’টি সম্মেলনে ও আসতে পেরেছিল। একটি সপ্তম পুনর্মিলনী আরেকটি নবম পুনর্মিলনী। কিন্তু আরেক সতীর্থ শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) একবারও আসতে পারেননি। দাওয়াতের তালিকায় ড. কাজী দীন মহম্মদ, অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী, বেবী মওদুদ, ফখরুল আবেদীন, কাজী রোজী, সেলিনা হোসেন, নূহ আলম লেলিন, নির্মলেন্দু গুণ, খ ম আব্দুল আউয়াল, হীরাফুল ফেরদৌসিসহ আরও অনেকে। তো, সপ্তম পুনর্মিলনী হয় হীরাফুল ফেরদৌসির বাসায় ১৯৯৮ সালের ৫ জুন। ওর হাজব্যান্ড মো. মনিরুজ্জামান তখন বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুল অ্যান্ড কলেজের (বর্তমান বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ রাইফেলস স্কুল অ্যান্ড কলেজ) অধ্যক্ষ। ওখানে এসেছিল সেলিম। আমরা প্রায় ৫০-৫৫ জন হাজির ছিলাম সে দিন। সবাই মজা করেছি।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি কখনও জানতে চাইলে উৎসাহভরে আতিকুল ইসলাম বললেন, ‘প্রায়ই যেতাম। আমাকে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস দেখাত। ওদের সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দিত। তারপর একসময় আমাকে নিয়ে বের হত। কথা বলতে বলতে ঘাসের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ইটের টুকরোতে কিক দিত, আনমনাও হয়ে যেত। ঠিক বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতো। আমরা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলাপ করতাম। একবার যখন শুনলাম যে ও অসুস্থ। তখন খ ম আব্দুল আউয়ালকে (তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পাবলিকেশন-এ ছিল) নিয়ে গেলাম। আমার কথা শুনে দেয়াল ধরে ধরে দেখা করতে এল। আমি বললাম, তুই উঠে এলি কেন? ও বলল, তুই এসেছিস, আর আমি আসব না?’

আতিকুল ইসলামের চোখটা আরও গাঢ় হয়ে গেল। পরিবেশটা যেন ধূসর হয়ে উঠল। প্রশ্ন করলাম, স্যারের মৃত্যুর আগে দেখা হয়নি?

কথাটা যেন ঠিক তার বুকের মধ্যে গিয়ে আঘাত করল। একটু ভেবে বললেন, ‘সম্ভবত সেলিম মারা যাবার ৬ মাস আগের কথা। দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে আমার। ব্যক্তিগত আলাপের ফাঁকে বলেছিল, তার শেষ নাটকটির কথা।’

এরপর আর কোনো কথা আছে কিনা সেটা ভাববার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। আতিকুল ইসলামের ব্যাচমেট, হলমেট, সতীর্থ সেলিম আল দীনের কথা শুনে নাট্যাচার্যের ‘নিমজ্জন’ নাটকের সংলাপ মনে পড়ল-‘পাঠ করো নতুন কালের গ্রন্থ। চলো মানুষ। চলো নতুন ভাবনাভূমিতে নব্যকালের নিশ্চিত গ্রহভূমিতে।’ এরপর উঠতে হল।

(দ্য রিপোর্ট/আইএফ/এইচএসএম/সা/জানুয়ারি ১৪, ২০১৪)