আদিত্য রুপু, দ্য রিপোর্ট : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ক্লাসরুম। ক্লাস শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। ছাত্রছাত্রীরা দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে। কারণ ক্লাস নেবেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ। ক্লাস শুরু হল। একেবারে পিনপতন নীরবতা। শুরুতে কয়েকজনকে ছোট ছোট কয়েকটা প্রশ্ন করলেন তিনি, বেশির ভাগই তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারল না। তখন তিনি বললেন, 'তোমরা তো কোনো লেখাপড়া করনি, কোনো কিছু জানো না।' কথাটা এক ছাত্রের মনে খুব লেগেছিল, নিজেকে সামলাতে পারলেন না তিনি। শেষে বলেই ফেললেন, 'আমি স্কুল-কলেজে থাকতে যা পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা পড়েছেন কিনা সন্দেহ।’

সবাই দেখল ছাত্রটিকে। কথাটার পিছনে একটা জোর ছিল। প্রমাণও ছিল। ছাত্রটি লিখেছিলেন ‘আমেরিকান নিগ্রো সাহিত্য’ নামে একটি প্রবন্ধ, এরই মধ্যে অনুবাদ করেছিলেন বিভিন্ন ভাষার গল্প। ছাত্রটি আহমদ শরীফকে সেদিনই জানালেন, তিনি নাটক লেখেন, পরদিন রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার লেখা একটি নাটক প্রচারিত হবে। ছাত্রটির বিশ্বাস, এ রকম নাটক এর আগে খুব একটা হয়নি। কথাটি বলেই হঠাৎ ছাত্রটির মনে হল, সর্বনাশ! কার সামনে কী বললেন তিনি। এখন পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচেন।

ক্যাম্পাসে পায়চারি করছিলেন ছাত্রটি। বন্ধুদের একজন এসে তাকে বলল, ‘শরীফ স্যার তোকে খুঁজছেন। এখনই দেখা করে আয়।’ শুনে কিছুটা কেঁপে উঠেছিলেন। কাঁপা কাঁপা বুকে অধ্যাপক আহমদ শরীফের কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন তিনি। ভেতরে কাজ করছিলেন অধ্যাপক শরীফ, সালাম শুনে মাথাটা একটু তুলে বললেন, ‘তোমার নাটক দেখলাম। তোমার অহংকার স্বার্থক।’ বলে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। ছাত্রটি এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটতে শুরু করলেন। আর ছুটতে ছুটতে একটা বড় বাজিতে জিতে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে বন্ধুদের এসে বললেন, ‘শরীফ স্যার নাটক দেখেছেন, স্যার বলেছেন, আমার অহংকার স্বার্থক।’ সেদিনের সেই ছাত্রটি হলেন বাংলাদেশের অন্যতম নাট্যকার সেলিম আল দীন, যাকে নিয়ে এ দেশের মানুষ অহংকার করে।

অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ক্লাস। মুনীর চৌধুরী কবিতা সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘উত্তর জানা না থাকলে বেরিয়ে যাও।’ মুনীর স্যারের কথার জবাবে টু শব্দ না করে সবাই মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য যখন পা বাড়াতে যাচ্ছে তখন তিনি তাদের বললেন, ‘বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দের মতো কবি এসেছেন, আরও কত কবি আছে বিশ্বসাহিত্যে, কবির কোনো শেষ নেই, শেষ নেই কবিতারও। তোমাদের মধ্যে কে জোর দিয়ে বলতে পারবে যে সে জীবনানন্দ দাশের চেয়ে ভাল কবিতা লিখতে পারবে? যদি না পার তাহলে কেন কবিতা লেখা?’ কিন্তু সেদিন মুনীর স্যারের কথার উত্তর না দিয়ে সবাই চুপ করে রইল। তখন তিনি বললেন, ‘তবে যারা নাটক লিখতে চাও তারা থাকতে পার।’ এটা ছিল কবি হতে চাওয়া একটি তরুণের (সেলিম আল দীন) জীবনের দ্বিতীয় ধাক্কা। তাহলে কি নাটকই তার জীবনের নিয়তি? কবি আহসান হাবীব বললেন, মুনীর চৌধুরী তাগাদা দিলেন আর বিষয়টা চূড়ান্ত করলেন আহমদ শরীফ। শুরু হল সেলিম আল দীনের নিয়মিত নাটক লেখা।

সেলিম আল দীনের আত্মজৈবনিক রচনায় এই ঘটনাগুলো বারবার উদ্ধৃত হয়েছে। কখনও ছাত্রদের পড়াতে পড়াতে নিজেই এ সব জানিয়েছেন তিনি।

সেলিম আল দীনের প্রথম নাটক প্রচারিত হয় রেডিও পাকিস্তানে। ‘বিপরীত তমসায়’ নামে এই নাটকটি প্রচারিত হয় ১৯৬৯ সালে। টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম নাটক ‘ঘুম নেই’। পাকিস্তান টেলিভিশনে ১৯৭০ সালে প্রচার হয়। ‘বিপরীত তমসায়’ ও ‘ঘুম নেই’ ছাড়াও রেডিও-টেলিভিশনে সেলিম আল দীনের অসংখ্য নাটক প্রচারিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হল– ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’ (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি), ‘অশ্রুত গান্ধার’ (বিটিভি, ১৯৭৫), ‘শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য’ (বিটিভি, ১৯৭৭), ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ (আয়না সিরিজ, বিটিভি, ১৯৮২-৮৩), ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ (বিটিভি, ১৯৯০-৯১), ‘ছায়া শিকারী’ (বিটিভি, ১৯৯৪-৯৫), ‘রঙের মানুষ’ (এনটিভি, ২০০০-২০০৩), ‘নকশীপাড়ের মানুষেরা’ (এনটিভি, ২০০০), ‘কীত্তনখোলা’ (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫)।

সেলিম আল দীনের ‘চাকা’ নাটক অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৪ সালে। ২০০০ সালে তার ‘কীত্তনখোলা’ নাটক থেকে নির্মিত হয় আরও একটি চলচ্চিত্র। এ ছাড়াও সেলিম আল দীন ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা করেন ১৯৯৪ সালে।

বর্তমান সময়ের নির্মাতারা সেলিম আল দীনের গল্প থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করে নাটক বানাচ্ছেন। কেউ কেউ তার গল্প নিয়ে আরও বড় আকারেও ভাবতে চাইছেন।

(দ্য রিপোর্ট/এআর/এইচএসএম/জানুয়ারি ১৩, ২০১৪)