দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন। তার সঙ্গে পড়েছেন অনেকেই। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন দ্য রিপোর্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন, বলেছেন তাদের প্রিয় সহপাঠীর কথা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী বললেন, ১৯৭২/৭৩ সালের কথা। আমি তখন ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক আর ম. হামিদ নাট্য সম্পাদক। সে সময় আমরা সাহিত্য, নাট্য ও ক্রীড়া চক্র মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, নাট্যোৎসব করব। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য বা উত্তম-সুচিত্রার যেসব রোমান্টিক সিনেমা চলতো, তার মতো হবে না। নাটকে শিল্পবোধসম্পন্ন সমাজের কথা থাকবে। চরিত্র ও বক্তব্যে পরিবর্তন থাকবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ছাত্র-ছাত্রীরা নাটক লিখবে। নাটক হবে ৩৫ মিনিটের। সেলিম আল দীন লিখলেন, ‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’। তারপর আমরা চালিয়ে গেলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন সেলিম আল দীন, আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, ম. হামিদ, খ ম হারূন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, খায়রুল আলম সবুজ, কবি শাহরুখ। সেলিম আল দীনের ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, হাবিবুল হাসানের ‘সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ’, কবি শাহরুখের ‘সভাপতি বললেন’, আমার ‘কালো অসুখ ও লাল ফুল’ নাটকগুলো প্রদর্শন করি। তখনও গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয়নি। তখন আরণ্যক কিছুটা কাজ করছে। আমরা ডাকসু কেন্দ্রিক নবনাট্য আন্দোলন শুরু করলাম। নাটকের ভাষা পরিবর্তন করতে চাইলাম। একটা কথা, পুঁজিবাদ যখন চরমে উঠে নৈরাশ্যবাদ সৃষ্টি হয়, আমি এ ধারণার বিপরীতে। সেলিমের সঙ্গে আমার নাট্যচিন্তার বৈপরীত্য ছিল। ও বলতো, নাটক মূলত কবিতা। সেলিম পরে লোকায়ত চিন্তাকে ধারণ করেছিল। তবে লোকনাট্যের মধ্যে বর্ণনাত্মক ভঙ্গি ব্যবহার করেছে। এটা ওর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি।’

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবদুল আউয়াল বললেন, ‘আমরা অনেক ক্লোজ ছিলাম। সহপাঠী হিসেবে সেলিম অনেক আন্তরিক ছিল। ও খুব পড়াশেনা করত। আমরা একসঙ্গে লাইব্রেরিতে পড়তাম। কিছুক্ষণ পড়ার পর ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতো। এতোটাই দুঃসাহসী ছিল। আমাদের মধ্যে এমন সাহস ছিল না। ধূমপান করার সময় কখনও কখনও আমি পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চার অধ্যায়’, লিও তলস্তয়ের ‘ওয়্যার এন্ড পিস’ এর নাতাশা চরিত্র-এরকম আরও অনেক সাহিত্য নিয়ে তুমুল আড্ডা চলত। ও বলত, আমি শুনতাম। আমাকে ভাল শ্রোতা মনে করে ও অনেক কথাই বলত। সেলিম অনেক মননশীল চিন্তা করত। সূক্ষ্ম সূক্ষ বিষয় বুঝতে পারত। একটা আধ্যাত্মিকতা তার মধ্যে ছিল। খ্যাতনামা সাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিমকে নিয়োগ দেন। বাদ পড়ে নিরঞ্জন (অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী)। সৈয়দ আলী আহসান সেলিমের ভেতরকার গুণাবলী ধরতে পেরেছিলেন। ওর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত।

একবার বাংলা একাডেমীতে ওর সঙ্গে দেখা হয়। আমি ঢুকছি আর ও বের হচ্ছে। আমাকে দেখে তার প্রকাশিত স্বর্ণবোয়াল বইটি দিয়ে বলল, তুই আমার বইটা নে (সেলিম আল দীনের শেষ সময়ের সাহিত্য স্বর্ণবোয়াল)। আমি বললাম, আমি তো তোমার বই কিনিই। ও বলল, তা কিন, আমার কাছ থেকে নে।’ এরপর বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। হাই, হ্যালো ছাড়া তেমন কোনো কথা হয়নি।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার অনুষ্ঠান বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফখরুল আবেদীন দুলাল বলেন, ‘আমরা প্রচুর আড্ডা মারতাম। সেলিম সাধারণ কেউ ছিল না। ও অনেক ভাবত। সব নাটক নিয়েই। আমরা যখন ক্লাস করতাম, তখন ও খুব বেশি মনোযোগী ছিল।’

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের বর্তমান সদস্য কবি কাজী রোজী বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমরা কত আড্ডা দিয়েছি। তখন ও নাটক নিয়েই বেশি কথা বলতো। একটা কথা মনে পড়ছে, ও মারা যাওয়ার কিছুদিন আগের কথা। শিল্প কলা একাডেমীতে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ওর সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখে বলল, আমি কথা বলি, তুমি কবিতা বল। আমি উচ্চারণ করি, তুমি গ্রহণ কর। এভাবেই আমাদের বন্ধুত্বের চলা।’ আমাদের মধ্যে এতো নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তারপর আমাকে আবার বলল, তোমার কিছু হবে না। আমি তখন ক্যান্সারের রুগি। ১৯৯৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত। সেলিম এটা জানত। তাই বলেছিল, তোমার কিছু হবে না। তুমি অনেক সাহসী ও শক্তিশালী। আমি ক্যান্সার নিয়েও বেঁচে আছি। সেলিম চলে গেল। ল্যাব এইড হাসপাতালে ও যখন মারা যায়, তখন আমি ওকে দেখতে রুমে ঢুকলাম। দেখতে চাইছিলাম যে এতো বেশি কথা বলতো, সে কতোটা নিথর হয়েছে। ও তো একেবারেই চলে গেল। সেলিম আমাকে ছেড়ে গেছে, কিন্তু কই, আমি তো সেলিমকে ছাড়তে পারছি না।’

(দ্য রিপোর্ট/আইএফ/এইচএসএম/জানুয়ারি ১৪, ২০১৪)