নবী দিবসের মুখবন্ধ
'জেগে ওঠ তুই রে ভোরের পাখি,/ নিশি-প্রভাতের কবি;/ লোহিত সাগরে সিনান করিয়া/ উদিল আরব রবি।/ ওরে ওঠ্ তুই, নূতন করিয়া/ বেঁধে তোল তোর বীণ?/ ঘন আঁধারের মিনারে ফুকারে/ আজান মুয়াজ্জিন।/কাঁপিয়া উঠিল সে ডাকের ঘোরে/ গ্রহ, রবি, শশি ব্যোম,/ ঐ শোন্ শোন্ সালাতের ধ্বনি/ খায়রুম-মিনান্নোম!' একজন সর্বোত্তম মহামানবের আগমনের সুসংবাদ জানাতে 'মরু ভাস্কর'-এ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এভাবেই শুরু করেছেন উপক্রমণিকা। প্রকৃতপক্ষে সেই মহামানবই পৃথিবী সৃষ্টির উপক্রমণিকা। আর তিনি হলেন, আমাদের পিয়ারে নবী হজরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা আহমদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
সব দেশে সব ভাষাতেই মহানবী (সা.)-কে নিয়ে এত অসংখ্য পুস্তক রচিত হয়েছে যে, সেই বিপুল গ্রন্থরাজি সর্বকালীন পৃথিবীর এক অপরাজেয় রেকর্ড ও বিস্ময়। কিন্তু চৌদ্দ শতাধিক বৎসরের এই ক্রমাগত আলোচনার পরেও মনে হয়, মহানবী (সা.)-কে নিয়ে এতদিনের এই সমগ্র আলোচনা-সমষ্টি একটি মুখবন্ধমাত্র, প্রকৃত আলোচনা এখনও শুরুই হয় নি। এ রকম যে মনে হয়, তার কারণ রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে মানুষের ভাবনা ও প্রেম ক্রমশ বেড়েই চলেছে, মানুষের চিন্তা ও গবেষণা ও রচনা শত বৈরিতার মধ্যেও আরও তীব্র, আরও গতিশীল হযে উঠেছে। সত্যিই কী মনোরম এই দৃশ্য, এমন কোন দেশ কী সমাজ কী ভাষা নেই যেখানে এই মহামানবকে সামনে রেখে নিঃস্বার্থ আলোচনার এক নির্মল প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে না। অর্থাৎ কিছু মানুষ বা অনেক মানুষ যতই অনীহ কী পরান্মুখ হোক, মহানবী (সা.)-র জীবন, চরিত্র ও আদর্শ সর্বদেশ ও কালে পরিব্যাপ্ত সমগ্র মানববংশের জন্যই এক শাশ্বত সম্পদ; কেউ তাঁকে অস্বীকার করে স্বকপোলকল্পিত স্বল্পায়ু'সুখস্বর্গ' রচনা করতে পারে, কিন্তু মানবগোষ্ঠির সার্বিক কল্যাণের প্রেক্ষাপটে তাঁর শিক্ষা ও আদর্শের অপরিহার্যতা চিরদিন একইভাবে অটুট ও উজ্জ্বল।
আর এটিতো খুবই সত্যি কথা পৃথিবীর কোনও উপার্জন তিনি কামনা করেননি, পার্থিব প্রতিষ্ঠা তিনি গ্রহণ করেননি, সম্মানের অহমিকার প্রয়োজন তাঁর ছিল না। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, মানুষে মানুষে বিবদমানতা দূর করা, আল্লাহ্র অংশীদারিত্বে অকল্যাণকর সাধন পদ্ধতি থেকে মানুষকে সরিয়ে আনা, মানুষকে কল্যাণব্রতী হওয়ার জন্য আগ্রহান্বিত করা, পার্থিব জীবনকে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় আনা, আবার সঙ্গে সঙ্গে পারলৌকিক জীবনের স্বস্তি কামনা করা। তাঁর উপর দায়িত্ব এসেছিল আল্লাহ্র অমোঘবাণীকে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। তাঁকে যখন সুস্পষ্টভাবে বলা হল যে আল্লাহতায়ালা তাঁকে নির্বাচিত করেছেন তাঁর বাণীকে গ্রহণ করার জন্য এবং পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে তা কার্যকরী করার জন্য, তখন তিনি সকলকে আহ্বান করলেন বিধাতার নির্দেশ মান্য করার জন্য। এ নির্দেশগুলো ছিল সুস্পষ্ট, পরিচ্ছন্ন এবং মানুষের বুদ্ধি এবং বিবেচনার আয়ত্বে। মানুষ তার বুদ্ধি ও বিবেচনার সাহায্যে সকল সত্যকে যাতে গ্রহণ করতে পারে সেজন্য কুরআন শরীফে সকল প্রকার অনুশাসন লিপিবদ্ধ আছে, ইতিহাসের সাক্ষ্য আছে এবং পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের জন্য বিধাতার উপঢৌকনের আশ্বাস আছে।
এই মহামানবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধের সর্বোচ্চ স্থান থেকে আজ আমরা তাঁকে স্মরণ করছি। তাঁর পবিত্র জন্ম ও ওফাত দিবসে তাই আমরা প্রকাশ করলাম 'নবী দিবস' নামে ক্রোড়পত্র।
প্রিয় পাঠক, এই সংখ্যাটি আশা করছি কিছুটা হলেও আপনাদের চিন্তার খোরাক জোগাবে।
সম্পাদক