মুহাম্মদ (স.)-র জীবনী ও তাৎপর্য
খন্দকার রাক্বীব
রবিউল আউয়াল মাসে মানব মুক্তির মহান দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-র দুনিয়ায় আগমন এবং ওফাত। দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত তাঁকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। তবুও অসংখ্য মানুষের কাছে তিনি এখনও ‘রহস্যাবৃত এক মহামানব’। মুসলিম পণ্ডিতদের উচিত এই মহামানবকে মানুষের কাছে আরও পরিচিত করে তোলা এবং দূরত্ব কমিয়ে আনা। এক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-র জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের খুঁটিনাটি বিস্তারিত আলোচনা, আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং বর্তমান সময়োপযোগী শিক্ষা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
তাঁর জীবনী স্পষ্ট করে দেয় কিভাবে এক এতিম যুবককে আল্লাহ বাল্যকাল থেকে প্রাপ্তবয়স পর্যন্ত দাওয়াতি মিশনের জন্য প্রস্তুত করেছেন। তাঁর ধ্যানমগ্ন স্বভাব, ব্যবসায়িক জীবন এবং এমন একজন নারীর সঙ্গে বিবাহ যিনি ছিলেন তাঁর থেকে বয়সে বড় ও তিনি তাঁর কর্মচারী ছিলেন- এসব কিছুতেই আছে শিক্ষা। যা তাঁর প্রতীকী এবং প্রস্তুতিমূলক শিক্ষার অংশ। একইসঙ্গে তা আমাদের জন্যও প্রতীকি ও চিন্তামুলক শিক্ষা।
নবুয়্যত প্রাপ্তির পর রাসুল(সা.)-র সবচেয়ে কঠিনতম সময়গুলোর দিকে আমাদের প্রত্যক্ষ করা উচিত। বোঝা উচিত তখন কেমনভাবে তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা নির্যাতিত হয়েছেন এবং তিনি কিভাবে এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করেছেন। তাঁর এই সংগ্রাম মজলুমের কাছে হতে পারে টিকে থাকারন জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। মদিনা রাষ্ট্র গঠন, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, মক্কা জয় করে দুনিয়ার বুকে ইসলাম ও সাম্যের দাওয়াত তিনি পোঁছে দিয়েছেন। যা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অসাধারণ দৃষ্টান্তমূলক আদর্শের ইঙ্গিত দেয়।
তিনি ঐশী বাণী লাভের মাধ্যমে বিশ্বমানবতাকে যাবতীয় দাসত্ব থেকে মুক্ত করে একমাত্র শরীকবিহীন আল্লাহর ইবাদতের দিকে নিয়ে গেছেন। তিনি বিশ্ব মানবতার চেতনায় ক্ষমা ও উদারতার ভিতগুলোকে সুদৃঢ় করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই’ মর্মে ঐশী বাণী প্রেরণ করেছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মুসলিমের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসকারী অমুসলিমদের সকল অধিকার নিশ্চিত করেছেন। তাদের জীবন, সন্তান, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা ঘোষণা করেছেন।
তিনি জগতের সকল কিছুর জন্য আল্লাহর রহমত হয়ে এসেছেন। পশুপাখিকে অকারণে কষ্ট দেওয়া কিংবা তাদের প্রতি বিরূপ আচরণে নিষেধ করেছেন। ছোট-বড় ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার রক্ষা করেছেন। এ ক্ষেত্রে সামাজিক মর্যাদার প্রতি পক্ষপাত করেননি। তার সাক্ষ্য দেয় ওফাতের তিন মাস আগে দেওয়া তাঁর বিদায় হজ্বের ভাষণ। এতে তিনি মানুষের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানে আঘাত হানাকে নিষিদ্ধ করেছেন। মানুষকে তিনি উত্তম আখলাক ও তার সহায়ক গুণগুলো বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন, যেমন- সততা, সত্যবাদিতা ও চারিত্রিক নিষ্কলুষতা। সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে পিতামাতার সঙ্গে সদাচার এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বলেন। তিনি নিজে মন্দ স্বভাব থেকে দূরে থেকেছেন, অন্যদেরও সতর্ক করেছেন,যেমন- মিথ্যা, ছলনা, হিংসা, ব্যভিচার ও পিতামাতার অবাধ্যচরণ। এসব থেকে সৃষ্ট সমস্যার প্রতিকারও বলে দিয়েছেন তিনি।
সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তা করতে উৎসাহ দেন তিনি। একে তিনি পুণ্যের কাজ বলেছেন। অথচ ওই সময় অন্য সভ্যতাগুলোতে জ্ঞানীরা নির্যাতন ভোগ করছিলেন। ধর্ম প্রচারকদের শাস্তি ও কারাভোগ এমনকি মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত দেয়া হচ্ছিল। তিনি আন্তঃসম্প্রদায়ে ভ্রাতৃত্বের পূর্ণাঙ্গ নমুনা পেশ করেন। জানিয়ে দেন কোনো সম্প্রদায়ের ওপর অন্য কোনো সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সৃষ্টি, অধিকার ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে তারা সবাই সমান। শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচিত হবে কেবল বিশ্বাস ও আল্লাহভীতির নিরিখে। তিনি তাঁর সকল সঙ্গীকে দীনের খেদমত করা এবং তাতে সম্পৃক্ত হওয়ার সমান সুযোগ দিয়েছেন। তাইতো আরবদের পাশাপাশি ছিলেন রোমের সুহাইব রূমী, হাবশী বিলাল এবং পারস্যের সালমান ফারসী (রা.) ছিলেন তাঁর কাছাকাছি।
পরিবেশ, বিয়ে-বন্ধুত্ব, যৌনতা, নারী স্বাধীনতা ও অধিকার, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, যুদ্ধ ও সংঘর্ষের সমাধান, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নেতৃত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তাঁর চিন্তা-কর্ম এখনো মুসলিম এবং অমুসলিমদের যুগপৎভাবে শিক্ষা দিচ্ছে।
তাঁকে বুঝার জন্য এবং তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে কুরআন এবং হাদিসের মর্মবাণী উপলব্দি। তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনা কুরআন-হাদিসের টেক্সট দিয়ে বিশ্লেষণ করলে যে আধ্যাত্মিক-নৈতিক শিক্ষা পাওয়া যায় তা এখনো প্রাসঙ্গিক।
তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.)বলেছিলেন, আল-কুরআনই রাসূল (সা.)-র চরিত্র। রাসুল (সা.)-কে বুঝতে হলে তাঁকে উপলব্দি করতে হবে। তাঁর শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে কুরআন অধ্যয়ন করা। তাই বলা চলে, মুসলিম এবং অমুসলিম নির্বিশেষে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উন্নয়নের জন্য রাসুল (সা.)-কে গভীরভাবে অনুসন্ধান করা ও তাঁর শিক্ষাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া অপরিহার্য।
লেখক: শিক্ষার্থী; উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।