রাষ্ট্র পরিচালনায় মহানবী (সা.)
মো. আব্দুস সোবহান
সার্বিকভাবে সফল এক মহান ব্যক্তিত্ব মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। প্রত্যেকটা কাজেই তাকে সফল হতে হয়েছে। কেননা তিনি তো সৃষ্টির সেরা। এখানে তিনি কীভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পত্তন করলেন সে বিষয়ে দৃকপাত করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ লেখায় দেখানো হয়েছে যখন আরবভূমি দারুণভাবে বিপন্ন, গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলছে অবিরাম- তখন তিনি মদিনা রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন।
প্রিয় পাঠক আপনাদের নিশ্চয় জানা রয়েছে, কখন কিভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের উৎপত্তি ও আবির্ভাব ঘটে। সে বিষয়টি অদ্যাবধি অমীমাংসিত রয়ে গেলেও এ বিষয়ে সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একমত যে, মানব সমাজের বৃহত্তর প্রয়োজনেই রাষ্ট্রযন্ত্রের উদ্ভব। দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল ও অন্যান্য প্রখ্যাত পণ্ডিত রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ক বিভিন্ন তাত্ত্বিক বক্তব্য পেশ করলেও রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ কোন যোগসূত্র ছিল না এবং আমাদের জানা মতে তাদের দর্শন ও চিন্তা-চেতনার আলোকে কখনও কোথাও কোন আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত তাদের বক্তব্য, চিন্তা-চেতনা, নীতিমালা ও দর্শন তাত্ত্বিক কাঠামো পেরিয়ে বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। পক্ষান্তরে, সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মহাম্মদ (সা.) মদীনা সনদের আলোকে মদীনাতে যে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, মানব জাতির ইতিহাসে এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে তা সর্বোত্তম জনকল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন আমদের প্রিয় রাসূল, বিশ্বনবী, বিশ্ব মানবতার মহান আদর্শ ও মহান শিক্ষক, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-র আবির্ভাবকালীন সময়ে তাঁর প্রিয় জন্মভূমি হিজায অঞ্চলসহ সমকালীন বিশ্বের তিনটি মহাদেশ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা ছিল রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সকল দিক দিয়ে পশ্চাপদতা ও পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ। মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক কোন উপাদান তখন বিদ্যমান ছিল না। অপর দিকে হিজাযের আশপাশের নিকটবর্তী ও দূরবর্তী দেশসমূহ, যেমন-পারস্য, রোম, মিশর, ইথিওপিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে তখন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল।
কিন্তু হিজাযে তখন রাজতন্ত্রের পরিবর্তে শায়েখতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। অর্থাৎ সেখানে শায়খ কর্তৃক শাসিত গোত্র ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মক্কাকেন্দ্রিক এ গোত্রভিত্তিক শাসন ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রথম পর্যায় হিসেবে অভিহিত করেন। ৬১০ ঈসায়ী সালে নব্যুয়ত প্রাপ্তির পর মহানবী (সা.) মক্কাকেন্দ্রিক জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দাওয়াতের মাধ্যমে আদর্শিক প্রচার-প্রসারমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মক্কার বৈরি পরিবেশ, কায়েমী স্বার্থবাদীদের প্রচণ্ড বিরোধিতা, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও গোত্রপতিদের অসহযোগিতা, সর্বোপরি জীবনের প্রতি চরম হুমকি প্রভৃতি কারণে তিনি আল আক্বাবার শপথের আলোকে মহান আলস্নাহ্ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশে ৬২২ সালে মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন।
এ সময় মদীনাতে তিন শ্রেণির জনগোষ্ঠী বসবাস করতো। এরা হচ্ছেন- মদীনার আদিম পৌত্তলিক সম্প্রদায়, বহিরাগত ইহুদী সম্প্রদায় এবং নবদীক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়। মহানবী (সা.)-র হিজরতের অব্যবহিত পরে মদীনায় মুহাজির ও আনসার মিলে মোট মুসলিম সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েকশ। পক্ষান্তরে এ সময় মদীনা নগরীর মোট জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক ১০ হাজার, যার প্রায় অর্ধেকই ছিল ইহুদী।
তখন মদীনাকেন্দ্রিক কোন সুসংঘবদ্ধ প্রশাসনিক কাঠামো এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা না থাকার কারণে উক্ত সব গোত্র প্রায়ই পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকতো। রাষ্ট্র গঠনের মূল চারটি উপাদান-নির্দিষ্ট ভূখন্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্বের মধ্যে প্রথম দুটি উপাদান তখন সেখানে বিদ্যমান থাকলেও শেষোক্ত দুটি উপাদান ছিল অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের অবস্থান নির্ণয়, স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ, পারস্পারিক সম্পর্ক ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা, গোত্রভিত্তিক সমাজ কাঠামোর পরিবর্তে একটি সার্বজনীন, বহুজাতিক ও বহুমাত্রিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং মদীনার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে হিজরতের প্রথম বর্ষেই মক্কা হতে আগত মুহাজির সম্প্রদায়, মদীনার আনসার সম্প্রদায়, ইহুদী ও আদিম পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে একটি লিখিত দলিল সম্পাদন করেন, যা ‘কিতাবুর রাসূল’ বা ‘মদীনা সনদ’ নামে বহুল পরিচিত। এটিই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সনদ বা সংবিধান, যা মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনা রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান এবং মূল ভিত্তি।
মহানবী (সা.) মদীনা সনদ জারি করেন মদীনায় বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে। এতে প্রতীয়মান হয় এ সনদ জারির পূর্বেই তিনি মদীনা রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং মদীনার সর্বময় শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী হন। আর রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে তিনি এ সনদ জারি করেন, নতুবা সনদ জারি করার কোন আইনগত কর্তৃত্ব তাঁর থাকে না এবং তা মেনে চলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোরও কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না। পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয় এবং তাঁকে মদীনার সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অন্য দিকে নাগরিকদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকার নির্ধারণ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং মহানবী (সা.)-র পূর্বানুমতি ব্যতীত কোন পক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার ঘোষণা, প্রকারান্তরে তাঁর চূড়ান্ত নির্বাহী কর্তৃত্বের অবস্থানকে আরও সুসংহত করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। সনদের ২৪তম এবং ৪৬তম ধারার আলোকে মদীনার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মহানবী (সা.)-এর নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এবং রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে তাঁর দায়িত্বভার গ্রহণের বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। ফলে মদীনা সনদ মদীনায় জনকল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লিখিত সংবিধানের আইনগত মর্যাদা লাভ করে। সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে তথা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদীনা রাষ্ট্রের প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি ১৯টি স্তর বিশিষ্ট একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামো মদীনাবাসীকে উপহার দেন।
এগুলো হচ্ছে-
১. রাষ্ট্র প্রধানের ব্যক্তিগত বিভাগ।
২. সীলমোহর বিভাগ।
৩. ওহী লিখন বিভাগ।
৪. রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধি প্রেরণ বিভাগ।
৫. অনুবাদ বিভাগ।
৬. অভ্যর্থনা বিভাগ।
৭. দাওয়াহ্ বিভাগ।
৮. প্রতিরক্ষা বিভাগ।
৯. আল্-শুরতাহ বা নিরাপত্তা বিভাগ।
১০. সমরাস্ত্র তৈরি ও সংরক্ষণ বিভাগ।
১১. বিচার বিভাগ।
১২. বায়তুল মাল বা রাজস্ব বিভাগ।
১৩. যাকাত ও সাদাকাহ্ বিভাগ।
১৪. জনস্বাস্থ্য বিভাগ।
১৫. শিক্ষা বিভাগ।
১৬. পরিসংখ্যান বিভাগ।
১৭. নগর প্রশাসন বিভাগ।
১৮. নগর উন্নয়ন ও প্রকৌশলী বিভাগ।
১৯. স্থানীয় সরকার বিভাগ।
পরিশেষে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সামাজিক সুবিচার ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.)-এর জীবনের এক চূড়ান্ত সফলতা।
লেখক: সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।
.