লেখাটি খুবই পরিশ্রমসাধ্য কর্মযজ্ঞ। এখানে গবেষক প্রতিফলিত করেছেন রাসূল (সা.)-এর যাপিত জীবনের অনুসঙ্গগুলি। তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের প্রতিচ্ছবিটুকুন এখানে সন্নিবেশ করেছেন। আর এই কাজের কাজটি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুবিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট গবেষক ড. মুফতি মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী। লেখকের নিজস্ব বানানরীতি এখানে রক্ষা করা হলো। পড়ুন তার সেই গবেষণাকর্মটি-

সফর পরিকল্পনা

অনেক দিনের স্বপ্ন-নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়ীতে যাব। নবীজীর বাড়ীতে অবস্থান করব। দেখব-নবীজীর জীবন পদ্ধতি। অবগত হব বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে। শুনব তার কথা। নবীজীর বাড়ীতে একটা দিন অবস্থান করে জানব অনেক কিছু। নবীজীর বক্তব্য ও কর্ম হবে আমার জীবনের আলো। এক মজার অভিজ্ঞতায় কেটে যাবে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।

মানুষ কোথাও যাবার পূর্বে সেখানে যাওয়ার পথ-ঘাট জেনে নেয়। সংগ্রহ করে গাইড বুক। ভ্রমণের স্থানগুলোর একটি মানচিত্র দেখে নেয়। আমি ভাবতে লাগলাম-আমার গাইড কি হবে? কীভাবে দেখতে পারব নবীজীর বাড়ীর বিভিন্ন দৃশ্য, অবগত হতে পারব তার ঘরোয়া জীবন সম্পর্কে। এতে করে পূরণ হবে আমার যুগ-যুগ ধরে লালন করা নবীজীর পরিবার দেখার স্বপ্ন।

আমি যদি নবীজী সম্পর্কে অবগত হতে পারি, তাহলে তো নবীজীর প্রতি ভালবাসা আরো বেড়ে যাবে। তার আখলাক, তার সীরাত আমার জন্য হবে অনুসরণীয়। তাহলে আমি পালন করতে পারব আল্লাহর সেই সব আয়াত-যাতে নবীজী সা. যা করতে বলেছেন, তা করা এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকাকে নবীজীর প্রতি ভালবাসার নিদর্শন বলা হয়েছে।

“(হে নবী!) আপনি জানিয়ে দিন-যদি তোমরা সত্যই আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। এতে করে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ মা করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি মাশীল, দয়াময়।”১

মহান আল্লাহ আরো বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ্‌র রাসূলের মাঝে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে যে আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের আশা করে এবং আল্লাহকে বেশী স্মরণ করে তার জন্য।”২

আল্লাহ তা‘আলা এমন ধরণের আয়াত কুরআনের প্রায় ৪০ স্থানে উল্লেখ করেছেন। আর বাস্তবতা হল-নবীজীর অনুসরণ ব্যতীত কোন মানুষ সফল হতে পারে না, কিয়ামতে নাজাত পাবে না। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন,

“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুসরণ করে, আল্লাহ পাক তাকে প্রবাহমান ঝর্ণা বিশিষ্ট বেহেশত দান করবেন। তা বিরাট সাফল্য। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা দেখাবে, আল্লাহর বিধান লংঘন করবে, তাকে তিনি এমন জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, যাতে সর্বদা থাকতে হবে। আর তার জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট শাস্তি।”৩

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসায় রয়েছে ঈমানের স্বাদ। নবীজী সা. বলেন,

১। আলকুরআনুল কারীম : সূরাহ আলি ‘ইমরান, আয়াত ৩১

২। পূর্বোক্ত : সূরাহ আহযাব, আয়াত ২১

৩। পূর্বোক্ত : সূরাহ নিসা, আয়াত ১৩-১৪

তিনটি বিষয় যার মাঝে হবে সে ঈমানের স্বাদ পাবে। এর প্রথমটি হল- আল্লাহ ও তার রাসূল তার কাছে হবে সবচেয়ে প্রিয়।৪

নবী কারীম সা. আরো বলেন-

তোমাদের কেউ পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতণ পর্যন্ত তার কাছে তার পিতা-মাতা ও সন্তান এবং অন্যান্য সকল মানুষ অপেক্ষা আমি বেশী প্রিয় না হব।”৫

সেই নবীর সীরাত, সেই নবীর চলা-ফেরা, আচার আচরণ ইত্যাদি জানার জন্যই আমি ছিলাম উদগ্রীব।

যাত্রা হল শুরু:

নবীজীর ঘর-সংসার দেখার জন্য, নবীজীর জীবনের মুহূর্তগুলো অবলোকন করার জন্য, তার লেন-দেন দেখার জন্য রওয়ানা হলাম। আর এ পথ চলার জন্য আদর্শ বাহন পেয়ে গেলাম। তা হল-বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী, সাহাবাগণের বর্ণনা। এটাই তো উত্তম পথ। এ পথেই জানা যাবে নবীজীর সবকিছু। এ পথই বৈধ পথ।

কিতাবের পাতায় ভর করে যখন নবীজীর মদীনায় পৌঁছলাম, তখন হিজরী নবম বর্ষ চলছে। প্রথমে নজরে পড়লো উহুদ পাহাড়। আর এ পাহাড় সম্পর্কে নবীজী সা. বলেছেন-

“এ পাহাড় আমাদেরকে ভালবাসে। আমরা তাকে ভালবাসি।”৬

৪। ইমাম মুসলিম: ছহীহ মুসলিম (লেবানন: দারুল কিতাবিল

‘ইলমিয়া, ১৯৯৪), খ. ২, পৃ. ১৩

৫। পূর্বোক্ত , খ. ২, পৃ. ১৫

৬। মুহাম্মাদ ইবনু ইসমা‘ঈল : ছহীহ আলবুখারী (বৈরুত:আলমাকতাবাতুছ ছাকাফিয়া, তা. বি.), খ. ৫, পৃ.২২৯

বাড়ীর আঙ্গিনায় :

মাগরিবের অল্প কিছুণ পূর্বে পৌঁছলাম নবীজীর বাড়ীর আঙ্গিনায়। আমি যখন রাসূলের ঘরে ঢুকতে যাব, তখন এর ভিত্তি ও আকৃতির দিকে ল্য করলাম। ছোট্ট বাসস্থান, সাধারণ ফোর, খেজুর পাতার ছাউনী, খেজুর কান্ডের বেড়া। দরজার সামনে চটের পর্দা ঝুলে আছে। পর্দাগুলো লক্ষণীয় ৩ হাত আর প্রস্থে ১ হাত।৭ তা দেখে আশ্চর্য হলাম না। কারণ, রাসূলুল্লাহ সা. পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে জাহিদ ব্যক্তি। তিনি দুনিয়ার চাকচিক্য ও সম্পদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না। এটাই স্বাভাবিক। বরং তার চোখ তো জুড়ায় নামাযে।

দুনিয়া সম্পর্কে নবীজী বলেছেন- “দুনিয়া নিয়ে আমার ভাবনা নেই। আমার কাছে দুনিয়াটা হল সেই পথিকের ন্যায়, যে গ্রীস্মকালের কোন এক দিবসে ভ্রমণ করছে। দিনের কোন এক মুহূর্তে গাছের নীচে সামান্যণ ছায়ায় বসে আবার চলা শুরু করেছে। আর সেই বিশ্রামের স্থানটি ছেড়ে চলে গেছে।”

আমি নবীজীর ঘরে প্রবেশ করলাম। নবীজীর স্ত্রীগণের ঘরগুলো দেখলাম কাঁচা ইটের উপর কাঁদা মাটির প্রলেপ দেয়া। কোনটি আবার পাথরের উপর পাথর দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সবগুলোর চাল হলো খেজুর বৃরে কান্ডের।

নয় জন স্ত্রীর জন্য নয়টি ঘর মসজিদের পাশে। মসজিদের পাশে লাগোয়া হল যাইনাব রা. এর ঘর। উম্মে সালামা রা. এর ঘরটি আধা পাকা দালান। আরো ২/৩ টি ঘর আধা পাকা করা নজরে পড়ল। বাকীগুলো খেজুর পাতার।৮

হযরত হাসান রা. বললেন, আমি নবীজীর স্ত্রীদের ঘরে একবার প্রবেশ করলাম। দেখলাম সেগুলোর চাল এত নীচু যে, তা হাতেই নাগাল পাওয়া যায়।৯

৭। মুহাম্মাদ ইবনু সা‘আদ : তাবাকাত কাবীর খ. ৩, পৃ. ২৮০

৮। পূর্বোক্ত খ. ৩, পৃ. ২৭৯

৯। পূর্বোক্ত খ. ৩, পৃ. ২৮১

নবীজীর চেহারা-আকৃতি :

বাড়ীর আঙ্গিনা পেরিয়ে এবার নবীজীর ঘরটির কাছে এগিয়ে গেলাম। তার দরজায় দাঁড়িয়ে আমি প্রবেশের অপোয়, ইতোমধ্যে কয়েকজন লোকের সাথে দেখা হল- যারা নবীজীকে দেখেছেন, তার সান্নিধ্যে বসেছেন, দু’নয়ন শীতল করেছেন নবীজীর অবয়ব দেখে। হৃদয়ের মাঝে গেঁথে নিয়েছেন নবীজীর আকার আকৃতি।

তাঁদের একজন আল-বারা ইবনে ‘আজিব রা.। তিনি বললেন, “নবী করীম সা. মানুষের মাঝে সবচেয়ে ভাল চেহারার অধিকারী। গড়নও তার সবচেয়ে আকর্ষনীয়। খুব বেশী লম্বাও নন, আবার খুব বেটেও নন।”১০

কেউ বারা ইবনু ‘আজিব রা.কে প্রশ্ন করল, নবীজীর চেহারা কি তলোয়ারের ন্যায় চমকায়? তখন তিনি জবাব দিলেন- “না, বরং তার চেহারা চাঁদের ন্যায়।”১১ (যা দেখতে চোখ ঝলসায় না, বরং আবেগমুগ্ধ করে।)

নবীজীর চোখ-মুখ সম্পর্কে জানালেন জাবির ইবনু সামুরা রা.। তিনি বললেন-

রাসূল সা. হলেন প্রশস্থ মুখ, লাল চোখ ও হালকা গড়নের।১২

নবী করীম সা. এর চুল সম্পর্কে ইবনু ‘উমর রা. থেকে জানা গেল মাত্র ২০টির মতো চুল পেকেছিল।১৩

১০। আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ বিন ‘ঈসা : সুনানু আততিরমিযী, খ. ৫, পৃ. ৫৫৮

১১। পূর্বোক্ত

১২। পূর্বোক্ত খ. ৫ পৃ. ৫৬৩

১৩। ইমাম আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু হাল : মুসনাদু আহমাদ

(লেবানন, দারু ইয়াহইয়াউততুরাছ, ১৯৯৩) খ. ২, পৃ. ২১৭

জাবির ইবনু সামুরা রা. আবার বললেন,

রাসূলের দু’ পায়ের নলা হালকা গড়নের। যখন তিনি হাসেন তখন মুচকি হাসেন। যখন আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি তখন মনে হয় তিনি দু’চোখে সুরমা দিয়েছেন। অথচ তখন তিনি সুরমা ব্যবহার করেননি।১৪

আবূ হুরাইরা রা. জানালেন, যখন রাসূলে খোদা পথ চলেন তখন মনে হয় উচু নীচু পথে পথ চলছেন।১৫ (ফলে সতর্কতার সাথে পা ফেলেন।)

রাসূলুল্লাহ সা. -এর আকৃতি ও গড়ন সম্পর্কে নবীজীর প্রিয় ভাজন ও তার চাচাতো ভাই ‘আলী ইবনু আবি তালিব রা. বললেন-

রাসূলুল্লাহ সা. খাট নন, আবার বেমানান লম্বাও নন। তার মাথার চুল বেশী কুকড়ানোও না আবার সোজাও না। হালকা কুকড়ানো কালো চুল। মাথা বড়। গায়ের রং রক্তিম বর্ণের। কাঁধের হাড় শক্ত। হাতের কব্জি ও পা

১৪। আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ বিন ‘ঈসা : সুনানু আততিরমিযী, খ. ৫, পৃ. ৫৬২

১৫। পূর্বোক্ত খ. ৫ পৃ. ৫৬৩

মোটা। তার বুক থেকে নাভী পর্যন্ত লোমের একটি রেখা রয়েছে। নরম ঠোঁট। লাল ঘন পলক বিশিষ্ট চোখ। চোখের দুই ভ্রু মিলিত। প্রশস্ত কপাল। প্রশস্ত কাঁধ। যখন চলেন তখন পা টিপে টিপে চলেন যেন তিনি উপর থেকে ঢালু পথে নামছেন। তার মত আর কাউকে ইতোপূর্বে দেখিনি। দেখিনি তার পরেও।১৬

জানলাম-

তার চোখ লালচে, দাড়িগুলো খুবই সুন্দর, মুখটাও সুন্দর। কান দু’টিও যথাযথ। ইবনু ‘আব্বাস রা. জানালেন, নবী করীম সা. এর সামনের দাঁত কিছুটা ফাঁকা । যখন কথা বলেন তখন যেন দু’দাঁতের মাঝ থেকে নূর বের হয়।১৭

নবীজীর গঠন সম্পর্কে আনাস রা. জানালেন, “নবীজীর হাত অপো নরম কোন রেশম বা অন্য কোন কিছু স্পর্শ করিনি। আর নবীজীর শরীরের ঘ্রাণের চেয়ে অধিক সুগন্ধি আর কোথাও পাইনি।”১৮

নবীজী সা. হলেন খুবই লাজুক। আবূ সা‘ঈদ খুদরী রা. বললেন-

রাসূলে কারীম সা. কুমারী কন্যা অপো বেশী লাজুক। যখন তিনি কোন অপছন্দনীয় জিনিস দেখেন, তখন তার (চেহারায় এর প্রভাব পড়ে ফলে আমরা তার) চেহারা দেখেই বুঝে।”১৯

১৬। আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল ইবনু কাছীর : শামায়িলুর রাসূল (লেবানন :দারুল মা‘আরিফাহ, ১৯৬৭) পৃ. ১৬

১৭। আবূ বাকার আহমাদ আলবাইহাকী : দালায়িলুন নুবুওয়াত খ. ১, পৃ. ২১৪

১৮। ‘আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ বিন ‘ঈসা : সুনানু আততিরমিযী, খ. ৪, পৃ. ৩২৪

১৯। ইমাম মুসলিম: ছহীহ মুসলিম, খ. ১৫, পৃ. ৭৮

নবীজীর পোশাক:

নবীজীর প্রধান পোশাক হল চাদর। অনেক সময় চাদর পরিধান করেই সাক্ষাত দেন আগত মেহমানদের সাথে। ‘উরওয়ার সূত্রে জানা যায় নবীজীর চাদর লম্বায় ছিল চার হাত আর প্রস্থে আড়াই হাত।

মাঝে মাঝে দামী কাপড় পরেছেন। ‘আব্দুল্লাহ ইবনুল হারিছ থেকে জানা গেল - নবী করীম সা. এক সেট পোশাক ২৭টি উটনীর বিনিময়ে ক্রয় করেন এবং তা পরিধানও করেন।২০

আনাস ইবনু মালিক রা. থেকে জানা যায় জিইয়া’যিন এর বাদশা ৩৩টি উটের বিনিময়ে এক সেট কাপড় ক্রয় করে নবীজীকে হাদিয়া করেন। নবীজী তা গ্রহণও করেন।২১

নবীজী আবার মোটা পশমী কাপড় পরিধান করেন। তবে তার প্রিয় কাপড় হলো বারা রা. এর মতে রাসূলের প্রিয় পোশাক হলো (ঢিলেঢালা) জামা।২২ আমরা জুব্বা পাঞ্জাবী বলতে যা বুঝি এ ধরণের।

বিভিন্ন রঙের কাপড় পরিধান করেন তিনি। লাল, হলুদ কাপড় সব সময় পরিধান করতে নিষেধ করলেও মাঝে মাঝে লাল-হলুদ মিশ্রিত কাপড় নবীজীও পরেছেন।২৩

কালো রঙের কাপড়ও পরেছেন। তবে নবীজীর বেশী প্রিয় রং হলো সবুজ আর সাদা।২৪

২০। ইবনু হাইআন: আখলাকুন নবী (রিয়াদ : দারুল মুসলিম, ১৯৯৮), খ. ২, পৃ. ১৬২

২১। সুলাইমান ইবনুল আশ‘আছ : সুনানু আবী দাঊদ, খ. ৪, পৃ. ৪৪

২২। পূর্বোক্ত খ. ৪ পৃ. ৪৩

২৩। পূর্বোক্ত খ. ৪ পৃ. ৫৪, আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ বিন ‘ঈসা : আশশামাইলুল

মুহাম্মাদিয়া (প্রকাশনীর নাম উল্লেখ নেই, ২০০১), পৃ. ৩৩

২৪। সুলাইমান ইবনুল আশ‘আছ : সুনানু আবী দাঊদ, খ. ৪, পৃ. ৫২

নবীজীর সা. কথাবার্তা :

নবীজীর গড়ন-আকৃতি জানার পর নবীজীর সাথে কথা বলতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। কথা বলতে যাব-এমন মুহূর্তে মনে হল-নবীজীর সাথে যারা সময় কাটিয়েছেন, তাদের কাছে শুনে নেই-নবীজী কিভাবে কথা বলেন। চিরায়ত নিয়মেই ‘আয়িশা রা. থেকে জানতে পারলাম, “রাসূল সা. খুব সুন্দর করে কথা বলেন, থেমে থেমে বলেন। উপস্থিত লোকেরা তা অনায়াসে মুখস্ত করে নিতে পারে।”২৫

তিনি সহজ নরম ভাষায় কথা বলেন যেন লোকেরা তার কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। তিনি লোক বুঝে কথা বলেন। শ্রোতা যে কথা যেভাবে বুঝবে, সেভাবেই বলেন। তিনি ধৈর্যের সাথে, সহনশীলতার সাথে প্রত্যেকের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যান।

‘আয়িশা রা. আরো বলেন-

‘‘নবীজীর কথা হতো পয়েন্ট পয়েন্ট করে। তাই যারা শুনতো, তারা সহজে বুঝে নিত’’।২৬

নবীজী হলেন বড় অন্তরের অধিকারী। তার সাথীগণ যেন ভাল করে বুঝে নিতে পারেন, সে জন্য কোন কোন বাক্য তিনি ২/৩ বার পর্যন্ত বলেন। এ তথ্যটি আনাস রা. এভাবে দিলেন-

২৫। ওলীউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু ‘আবদিল্লাহ আততিবরিযী : মিশকাতুল মাসাবীহ

(বৈরূত : আলমাকতাবাতুল ইসলামিয়া ১৯৮৫), খ. ৩, পৃ. ১৬২০

২৬। সুলাইমান ইবনুল আশ‘আছ : সুনানু আবী দাঊদ (মক্কা :

দারুল বায, তা. বি.), খ. ৪, পৃ. ২৬১

“রাসূল সা. কোন কোন বাক্য ৩ বার বলতেন, যেন তা ভালভাবে বুঝে নেয়া যায়।”

তিনি মানুষের সাথে নরম মেজাজে মিশেন। তবে যখন চুপ থাকেন, তখন তার গাম্ভীর্যের কারণে কেউ মিশতে ভয় পায়। এ ব্যাপারটি ইবনু মাস‘উদ রা. বললেন এভাবে- “রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে এক লোক এল। নবীজীর সাথে কথা বলল সে। ভয়ে তার দু’হাটু কাঁপছিল। তখন নবী করীম সা. বললেন, সহজ হতে চেষ্টা কর। কেননা, আমি কোন রাজা-বাদশাহ নই। নিশ্চয় আমি এমন এক মহিলার সন্তান-যে শুকনা গোশত খেতে।”২৭

২৭। আবূ ‘আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ আল কাযবীনী : সুনানু ইবনু মাজাহ (লেবানন: দারু

ইয়াহইয়াউত তুরাছ আল‘আরাবিয়া, ১৯৭৫), খ. ২, পৃ. ১১০০

ঘরে যখন প্রবেশ করলাম :

ঘরের বাইরেই নবীজী সা. সম্পর্কে জানলাম অনেক কিছু। নবীজীর ঘরে প্রবেশ করতে যাব। তখন অনুমতি নেয়ার ব্যাপার। ঘরে প্রবেশের পূর্বেই অনুমতি নিতে হয়। এটাই নবীজীর নির্দেশ। বনী ‘আমিরের এক ব্যক্তি রাসূল সা. এর ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি চেয়ে বললেন, আমি কি ঢুকব? তখন নবীজী তার খাদিমকে বললেন, যাও ঐ লোককে অনুমতি নেয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দাও। তাকে বল, আপনি বলবেন আসসালামু আলাইকুম। আমি কি প্রবেশ করতে পারি? এ কথা ঐ ব্যক্তি শুনলেন। তাই ঐ ব্যক্তি বললেন তখন নবীজী তাকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তারপর সে ঘরে প্রবেশ করল।২৮

ইতোমধ্যে ঘরে প্রবেশের অনুমতি এল। ঘরে প্রবেশ করার জন্য রাসূল সা. -এর একটি শিা জানলাম আবূ মালিক আল আশ‘আরী থেকে। তিনি বললেন, রাসূল সা. বলেছেন, যখন কোন ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশ করবে তখন যেন সে বলে-

তার পর তার পরিবারের লোকদেরকে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করবে।২৯

প্রবেশ করলাম ঘরে। নবীজীর ঘরের মাঝে চাটাই বিছানো আছে। আমার দৃষ্টি ঘুরতে থাকল। আমার দৃষ্টি গোচর হল- এ ঘরেই বসবাস

২৮। সুলাইমান ইবনুল আশ‘আছ : সুনানু আবী দাঊদ, খ. ৪, পৃ. ৩৪৫

২৯। পূর্বোক্ত খ. ৪ পৃ. ৩২৫

করেন নবীজী। ঘাস আর খড়কুটায় তৈরী বিছানা। খেজুর গাছের বাকলের বালিশ। ঘরের অন্যান্য জিনিসের প্রতিও নজর পড়ল। পাতিল-বাসন কোনটি দৃষ্টি এড়ালো না।

নবীজীর সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ বললেন-

রাসূলুল্লাহ সা. একটি চাটাই -এর উপর শুয়ে আছেন। চাটাই -এর দাগ নবী করীম সা. এর গায়ে লেগে গেছে। তা দেখে আমরা বললাম, আপনার জন্য আমরা তোষকের ব্যবস্থা করি। তখন নবীজী সা. বললেন, রাখ দুনিয়া! দুনিয়ার আরাম দিয়ে কি হবে? আমি তো পৃথিবীর বুকে এক পথিকের ন্যায়, যে গাছের ছায়ায় সামান্য সময় বিশ্র্রাম করে আবার সে স্থান ত্যাগ করে চলে যায়।৩০

নবীজীর ঘরটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আমার নজর পড়ল দেয়ালের দিকে। আজকাল তো অনেক ঘরের দেয়ালে নানা রঙ্গের ছবি টাঙ্গানো থাকে। কোথাও স্মরণীয় ব্যক্তিদের, কোথাও দেখা যায় নায়ক-নায়িকাদের ছবি টাঙ্গানো আছে। আবার কারো কারো ঘরে কোন প্রাকৃতিক দৃশ্যও থাকে। নবীজীর ঘরের দেয়ালে তাই চোখ বুলাতে লাগলাম। দেয়ালে কোন ছবিই আমার চোখে পড়ল না। আর প্রাণী জাতীয় ছবি নবীজীর ঘরে থাকবেই কিভাবে? নবীজীই তো বলেছেন “যে ঘরে কুকুর বা (কোন প্রাণীর দৃশ্যমান) ছবি থাকে, সে ঘরে (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করেন না।”৩১

দেয়াল থেকে চোখ নামিয়ে নিলাম নীচের দিকে। খোঁজ শুরু করলাম-নবীজী সা. কি কি জিনিস ব্যবহার করেন?

৩০। আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ বিন ‘ঈসা : সুনানু আততিরমিযী, খ. ৪, পৃ. ৫০৮

৩১। ইমাম নাসাঈ : সুনানু নাসাঈ (হালব, ১৯৯৪), খ. ৭, পৃ. ১৮৫

ছাবিত রা. থেকে জানলাম, তিনি বললেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ সা. এর বিশেষ খাদিম আনাস ইবনু মালিক রা. কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। জবাবে তিনি একটি কাঠের পেয়ালা দেখালেন; যাতে লোহার পাত দিয়ে মুড়ানো ছিল। পাত্রটি দেখিয়ে আনাস বললেন, এটা হল নবীজীর পাত্র। এতে করে তিনি পানি পান করেন, নাবীয (খেজুর ভিজানো শরবত) পান করেন। এটি দিয়েই মধু পান করেন। দুধও পান করেন এটি দিয়ে।৩২

আনাস রা. থেকে আরো জানলাম, রাসূলে কারীম সা. যখন এ পাত্র দ্বারা কোন কিছু পান করেন, তখন তিন শ্বাসে পান করেন। প্রতিবার থেমে থেমে পান করেন। প্রতিবার শ্বাস ফেলেন পাত্রের বাইরে। তিনি পাত্রের ভিতরে শ্বাস ফেলেন না। পাত্রের ভিতরে শ্বাস ফেলা অপছন্দ করেন। তা নিষিদ্ধও করেছেন।৩৩

আগেই জেনেছি -রাসূলুল্লাহ সা. এর একটি লৌহবর্ম আছে। বর্মটি শরীরে পরে তিনি যুদ্ধ করেন। এ পোষাকটি দেখার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে পড়ল। পুরো ঘর খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না। ‘আয়িশা রা. থেকে জানলাম, এটি এক ইয়াহুদীর কাছে বন্ধক রেখেছিলেন। বর্মটি বন্ধক রেখে ৩০ ছা‘ (১০৫ কেজি) গম এনেছিলেন পরিবারের খাবারের জন্য। এছাড়া যে আর কোন উপায় ছিল না। ভেবেছিলেন- গমগুলো পরিশোধ করে দিয়ে বর্মটি ছাড়িয়ে আনবেন। আর্থিক অনটনে সে সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। আর বর্মটি ইয়াহুদীর কাছেই রয়ে গেল।৩৪

নবীজী সা. হলেন খুবই অল্পে তুষ্ট ব্যক্তি। তিনিই বলেছেন, “যার ভাগ্যে ইসলাম জুটেছে, তার জন্য সুসংবাদ। সুসংবাদ তার জন্যও, যার ন্যূনতম প্রয়োজন মাফিক জিনিসের ব্যবস্থা হয়েছে আর সে এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।” মহানবী সা. আরো বলেছেন, “যার ঘরে একদিনের খাবার আছে, সে যেন দুনিয়ার সব প্রাচুর্য পেয়েছে।”

৩২। ইমাম আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু হাম্বল : মুসনাদু আহমাদ, খ. ৪, পৃ. ১৩৫

৩৩। আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ বিন ‘ঈসা : সুনানু আততিরমিযী, খ. ৪, পৃ. ২৬৯

৩৪। ইমাম আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু হাম্বল : মুসনাদু আহমাদ, খ. ৭, পৃ. ৬১১

ও খ. ১, পৃ. ৩৯১

আত্মীয়-স্বজনদের সাথে:

রাসূলুল্লাহ সা. তার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে মিলে মিশে থাকেন। সবার সাথেই তার সদ্ভাব। তার সততা আর নিষ্ঠার কারণে তিনি আল-আমীন উপাধি লাভ করেছেন। যেদিন তিনি প্রথম নুবুওয়াত লাভ করেন, সেদিন জিবরাঈল ‘আলাইহিস সালামকে দেখে ফেরার পথে জ্বর চলে আসে। ভয়ে-শংকায় বাড়ী ফিরলেন। মনে করছিলেন- ভয়ের কারণে তিনি মারাই যাবেন। খাদীজা রা. তাকে তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন-

‘‘আপনি ঘাবড়াবেন না। আপনার উপর কোন বিপদ আসবে না। আল্লাহ আপনাকে অপমাণিত করবেন না। কারণ- আপনি আত্মীয়তা বজায় রাখেন। কমজোরকে সাহায্য করেন। নিঃস্বের আয়ের ব্যবস্থা করেন। মেহমানদারী করেন। বিপদে সাহায্য করেন। সবার সাথে ভাল আচরণ করেন। সত্য কথা বলেন।’’৩৫ খাদীজা রা. এর বক্তব্য প্রমাণ করে নবীয়ে আকরাম সা. আত্মীয়তা বজায় রাখতে অভ্যস্থ।

নবীজী সা. তার মাকে হারান ৫/৬ বছর বয়সে। মায়ের প্রতি তার টান অপরিসীম। আবূ হুরাইরা রা. জানালেন, নবীজী সা. তার মায়ের কবর যিয়ারত করেন। কবরের কাছে গিয়ে তিনি আবেগে কেঁদে ফেলেন। তার সেদিনের কান্না দেখে আশ-পাশে যারা ছিলেন, তারাও চোখের পানি সামলে রাখতে পারেননি।৩৬

৩৫। মুহাম্মাদ ইবনু ইসমা‘ঈল : ছহীহ আলবুখারী, খ. ১, পৃ.৪

৩৬। আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আলহাকিম আননিসাবুরী : আলমুসতাদরাক ‘আলাছছাহীহাইন (লেবানন : দারুল মা‘আরিফাহ), খ. ৩ পৃ. ৫০৩

নবীজী সা. নিজে থেকেই সেদিন লোকদেরকে জানালেন, ‘‘আমি আল্লাহর কাছে (আমার মায়ের মুক্তির জন্য) মা চাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই অনুমতি আমি পাইনি। এর পর আমি কবর যিয়ারত করার অনুমতি চাইলাম। তখন আমাকে কবর যিয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়। তোমরাও কবর যিয়ারত কর। কেননা, কবর যিয়ারত মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’’৩৭

শুধু যে মায়ের প্রতিই তার ভালবাসা, তা নয়। বরং তার ভালবাসা তার আত্মীয় স্বজন সকলের প্রতি। তার বংশের প্রতিটি মানুষের প্রতি।

নুবুওয়াত পাওয়ার ৩ বছর পরের ঘটনা। যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জানিয়ে দিলেন এবং দায়িত্ব দিলেন“আপনার নিকট-আত্মীয়দেরকে (আল্লাহর) ভয় দেখান।”৩৮ তখন তিনি তাড়াহুড়া করে তার আত্মীয়-স্বজনদেরকে এক পাহাড়ের পাদদেশে ডাকলেন। তার সে আহবান ছিল হৃদয়কাড়া। সে ডাকে তার আত্মীয়দের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও ভালবাসা যেন উপচে পড়ছিল। তিনি ডাক দিলেন- হে বনী আবদি শামস! হে বনী কা‘ব বিন লুয়াই! তোমরা তোমাদেরকে দোযখ থেকে বাঁচাও। হে বনী মুররা বিন কা‘ব! তোমাদেরকে আগুন থেকে বাঁচাও। হে বনী আবদি মানাফ! হে বনী হাশিম! জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরা কর। হে বনী আবদিল মুত্তালিব! সাবধান হও, আগুন ধেয়ে আসছে। হে ফাতিমা! তুমিও আগুন থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা চালাও। কারণ, আল্লাহর সামনে আমি তোমাদের ব্যাপারে কোন কিছু করার মতা রাখি না।৩৯

৩৭। আননিসাবুরী : আলমুসতাদরাক ‘আলাছছাহীহাইন , খ. ৩ পৃ. ৫০৩

৩৮। আলকুরআনুল কারীম : সূরাহ আশশু‘আরা, আয়াত ২১৪

৩৯। ইমাম মুসলিম: ছহীহ মুসলিম, খ. ১, পৃ. ৭৯

ইবনুল আছীর : আলকামিল ফিত তারীখ, (বৈরূত

দারুছ ছাদির, ১৯৯৫) ৬ষ্ঠ সংস্করণ, খ. ২, পৃ. ৬০

তার চাচা আবূ তালিবের প্রতি তার দরদের কাহিনীটি না বললেই নয়। আবূ তালিব যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত, তখন নবীজী সা. সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, “হে চাচা! আপনি “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলুন। শুধু এটুকু বললেই আমি এ বাক্যটির দ্বারা আপনার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে প্রমাণ দিতে পারব আপনার ইসলাম গ্রহণের। ইতস্তত: না করে বলে ফেলুন।”

সেখানে আগে থেকেই আবূ জাহল, আব্দুল্লাহ বিন আবী উমাইয়্যাহ বসা ছিল। তারা বলা শুরু করল- কি করতে যাচ্ছ আবূ তালিব? তুমি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম থেকে সরে যাবে?

আবূ জাহ্লদের বাধা শুনেও নবীজী সা. বুঝানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবূ তালিব আব্দুল মুত্তালিবের ধর্মেই অটল থাকল।৪০

এরপরও নবীজী সা. তার চাচার প্রতি ভালবাসা মুছে ফেলতে পারেননি। তার চাচার জন্য দু‘আ করতে লাগলেন। ইস্তিগফার করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে কোন মুশরিকের জন্য মা চাওয়ার অনুমতি তার থাকেনি। তখন নবীজী সা. মা চাওয়া বন্ধ করে দিলেও প্রায়ই তার চাচার স্মৃতিচারণ করেন।

৪০। ইমাম মুসলিম: ছহীহ মুসলিম, খ. ১, পৃ. ২১৪

আল্লামা শিবলী নু‘মানী ও সুলায়মান নদবী : সীরাতুন নবী, (লাহোর :

হুযায়ফাহ একাডেমী, ২০০০), খ. ১, পৃ. ১৪০

যখন সন্ধ্যা নামে :

নবীজীর বাড়ীতে যখন অবস্থান করছি তখন শুনতে পেলাম আজান। হ্যাঁ, সূর্য অস্ত গিয়েছে। এখনই পড়তে হবে মাগরিবের নামায। দলে দলে সাহাবায়ে কিরাম মসজিদে আসছেন। অনেকে এই মাত্র মেষ বকরীর পাল নিয়ে ফিরে এসেছেন। পাল ঘরে রেখেই চলে এসেছেন মসজিদে। কেউ কেউ গিয়েছিলেন বিকেল বেলা খেজুর বাগানটি দেখতে। ভালই ফল হয়েছে এবার। গত বছর এত ফলন হয়নি। অভাব অনটনে চলছে সময়। বাগানের প্রায় পেকে উঠা খেজুর দেখে মনে অনুভব করছিলেন শান্তি। পরিস্কার করে দিচ্ছিলেন আগাছা, ছাল-বাকলগুলো। মাগরিবের আজান শুনতেই সব বন্ধ করে চলে এসেছেন নামাযে।

যথা সময়ে শুরু হল মাগরিবের নামায। আহ! সে কি মধুর সুর। সাবলীল ভাষায় কিরআত পড়া চলল। আদায় করা হল রুকু, সিজদা, কাওমা, জলসা। এক সময় শেষ বৈঠক শেষে সালাম দ্বারা শেষ করা হল নামায। নামাযের পর তাসবীহ। আওয়াবীন নামায ইত্যাদির পর সবাই চলে গেল তাদের বাড়ী। নবীজীও ফিরেন এ সময়ে তার স্ত্রীদের ঘরে। চলে আলাপ আলোচনা। চলে নারী শিা কার্যক্রম।

নবী সা. যখন বাড়ীতে থাকেন তখন সন্ধ্যার পর নামায শেষে সবাই একত্রিত হয় নির্দিষ্ট ঘরে। নবীজী রাত কাটানোর পালা যে ঘরে সেই ঘরেই। সেখানে চলে দীন ও শরী‘অত শিক্ষার কার্যক্রম। অনেক সময় আশেপাশের মহিলারাও অংশ নেয় এ তা’লীমী মজলিসে। পর্দার আড়াল থেকে প্রশ্ন করে কোন কোন মহিলা। জেনে নেন জীবন চলার পথ।

নবীজী সা. যখন বাড়ীতে :

একজন লোক বাহিরের লোকদের সাথে অনেক সময় ভাল আচরণ করে, কিন্তু সে যখন বাড়িতে থাকে, তখনই তার আসল রূপ ধরা পড়ে। তাই বলা হয়- যে তার পরিবারের লোকজনের কাছে ভাল সে প্রকৃতই ভাল। সে হিসেবে নবীজীর ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে নবীজীকে পেয়েছি একজন আদর্শ স্বামী, একজন আদর্শ পিতা, একজন আদর্শ মনিব হিসেবে।

তিনি যখন তার স্ত্রীগণের সাথে মিশেন, তখন স্ত্রীগণ হন মুগ্ধ। তার আচরণে সবাই হয় খুশী। তার স্ত্রী ‘আয়িশা রা. বললেন, “আমার স্বামী নবীজী সা. অন্যান্য মানুষের মতোই একজন মানুষ। (তার মাঝে রাজকীয় কোন ভাব নেই।) তিনি কাপড় সেলাই করেন। তিনি বকরীর দুধ দোহন করেন। নিজের কাজ নিজেই করে নেন তিনি। তার মাঝে আছে নম্রতা আর বিনয়। অহংকার বলতে কিছুই নেই। তিনি ভদ্র ও মার্জিত আচরণের অধিকারী। এক কথায়, মানুষের মাঝে যত ধরণের ভাল গুণ হতে পারে, সবই আছে তার মাঝে। তার সুন্দর আচরণের ফলে তার ঘর থেকে বিকশিত হয়েছে হিদায়াতের আলো। মানুষ পেয়েছে তার কাছে সত্যের দিশা। তিনি ঘরে যতণ থাকেন, খাওয়ার পিছনে পড়ে থাকেন না। অনেক সময় শুকনো খেজুর খেয়েই কাটিয়ে দেন দিন।”৪১

তার স্ত্রী আয়িশা রা. আরো বললেন, “এক মাস পর্যন্ত দেখা যেতো-আমাদের ঘরের চুলায় আগুন জ্বলেনি। আমরা তার বাড়ীতে এভাবেই কাটিয়ে দিতাম। বড়জোর খেজুর বা পানির ব্যবস্থা হতো।”

আমরা যখন ঘরে থাকি, তখন স্ত্রী, পুত্র-কন্যাকে নিয়ে এক কথায় সংসারে আমরা ডুবে যাই। নবীজীও কি এমন করেন এমন প্রশ্ন এলো মনে। ‘আয়িশা রা. থেকেই উত্তর পেয়ে গেলাম-

৪১। আবুল হাসান ‘আলী নদবী : আসসীরাতুন নববিয়া (লাখনৌ : আলমাজামা‘উল ইসলামী আল‘ইলমী, তা. বি.) পৃ. ৪৪৭

“নবীজী সা. কখনও ঘরোয়া কাজে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু যখনই আজান শুনেন, তখনই তিনি বেরিয়ে পড়েন নামাযের উদ্দেশ্যে।”৪২

নবীজীকে কোন কিছুই নামায থেকে গাফিল করে রাখতে পারে না। যখন ডাক শুনেন তখনই তিনি সেই ডাকে সাড়া দেন। তার স্ত্রী বা পরিজন তাঁকে আগলে রাখতে পারেন না। তার বেশ কয়েকজন স্ত্রী-ই বলেছেন-যখন তিনি আজান শুনেন তখন তার চেহারায় পরিবর্তন আসে। তিনি তখন কিসের টানে যেন ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তখন মনে হয় তিনি আমাদেরকে চিনেনই না।

নবীজী সা. একদিন সাহাবাদেরকে বলেছিলেন, কেউ যদি আজান শুনে আর সে ডাকে সে সাড়া না দেয়, তাহলে তার নামাযই যেন হল না। তবে সমস্যা থাকলে (যেমন নিরাপত্তার অভাব বা রোগ হলে) ভিন্ন কথা।

নবীজী সা. একদিন জামা‘আতে নামায পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বললেন, আমার তো ইচ্ছা হয়-একদল লোককে খড়ি সংগ্রহ করতে বলি। এদিকে নামাযের জন্য ডাক দেয়া হবে। যারা নামাযের জামা‘আতে উপস্থিত হবে না, তাদের বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দিব।৪৩ (কেন তারা বাড়ী-ঘরের মায়া ছাড়তে পারে না?) কিন্তু তা করিনা, যেহেতু বাড়ীতে নারী ও শিশু রয়েছে।

৪২। মুহাম্মাদ ইবনু ইসমা‘ঈল : ছহীহ আলবুখারী, খ. ১, পৃ.২৭২

৪৩। পূর্বোক্ত খ. ১ পৃ. ২৬২

নবীজীর স্বভাব :

মানুষের উঠা-বসা, কথা-বার্তায় ফুটে উঠে তার জ্ঞান-বুদ্ধি। প্রকাশ পায় তার মানসিক অবস্থা। নবীজীকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন, তার সাথে শয়নে-স্বপনে, সুস্থ-অসুস্থ অবস্থায় প্রচুর সময় দিয়েছেন, তারা বলতে পারবেন- নবীজী সা. কেমন মানুষ? তাহলে আসুন, শুনি তার স্ত্রী হযরত ‘আয়িশা বিনতে আবূ বাকার রা. কী বলেন?

‘আয়িশা সিদ্দিকা রা.এক প্রশ্নের জবাবে বললেন, “রাসূলুল্লাহ সা. অশ্লীল কাজ করতেন না, খারাপ গালি দিতেন না। বাজারে হট্টগোল করতেন না। কেউ তার সাথে খারাপ আচরণ করলেও তিনি খারাপ আচরণ করতেন না। বরং তাকে মা করে দিতেন, ছাড় দিতেন।”৪৪

রাসূলুল্লাহ সা. এর নাতী হুসাইন রা. বলেন, আমি একবার আমার আব্বা আলী রা. কে জিজ্ঞাসা করলাম নবীজীর সীরাত সম্পর্কে। আব্বা জবাবে বললেন, নবী করীম সা. সর্বদা হাসিমুখে থাকতেন। তার প্রতিবেশী বা মুসাফিরের সাথে নরম আচরণ করতেন। রুভাব তার মাঝে ছিল না। শোরগোলও তিনি করতেন না। মানুষের দোষ খোঁজার তালে থাকতেন না। যে জিনিস তিনি পছন্দ করতেন না, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতেন। কোন ব্যক্তি তার কাছে আশা নিয়ে কোন কিছু চাওয়ার পর নিরাশ হতো না। তার থেকে কেউ বঞ্চিত হত না।

জানলাম নবীজী তিনটি বিষয় থেকে দূরে থাকেন: (ক) রিয়া বা লোক দেখানো ভাব, (খ) সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা, (গ) অহেতুক কথাবার্তা।

তিনি মানুষদেরকে তিনটি কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেন : (ক) কোন মানুষকে তিরস্কার না করা এবং কারো দোষ না ধরা। (খ) কারো গোপন বিষয় খুঁজে না বেড়ানো। (গ) যাতে কোন ছাওয়াবের আশা নেই-এমন কথা বার্তা না বলা।

৪৪। আবুল হাসান ‘আলী নদবী : আসসীরাতুন নববিয়া, পৃ. ৪৩৪

নবীজীর মজলিস:

নবীজী সা.-এর মজলিস হয় অত্যন্ত আকর্ষণীয়। যখন তিনি কথা বলেন তখন শ্রোতারা চুপ করে শ্রবণ করেন। তারা নড়েন না। মনে হয়-যেন তাঁদের মাথায় পাখি বসে আছে।৪৫

নবীজীর সা. দরবারের কথা বলছিলাম। নবীজী সা. এর মুখ নি:সৃত কিছু উপদেশ শুনার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। সাহাবায়ে কিরাম কোন্ কথা শুনার জন্য এত মনোযোগী, এতো আগ্রহী হন যে, কথা শুনতে গিয়ে একটু নড়াচড়াও করেন না। আমার মন যখন ব্যাকুল, তখন বিভিন্ন সময়ে বলা রাসূলের উপদেশগুলো জানতে লাগলাম। এর মধ্যে দু’চারটি বাক্য এমন-

* “যখন কোন অভাবীর প্রয়োজন তোমার সামনে ধরা পড়ে, তখন অভাবীর প্রয়োজন পূরণে সাহায্য কর।”

* “মুসলিম তো সেই ব্যক্তি-যার ভাষা ও শক্তি থেকে মানুষ নিরাপদ।৪৬ আর ত্যাগী (মুহাজির) তো সেই ব্যক্তি- যে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে পেরেছে।”

* “যারা রাতের অন্ধকার উপো করে মসজিদে যায় (জামা‘আতে) নামায পড়ার জন্য , তাদের জন্য কিয়ামত দিবসে পূর্ণ আলোক প্রাপ্তির সুসংবাদ রয়েছে।”

* “মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর তোমাদের ধন-সম্পদ দ্বারা, তোমাদের জীবন দ্বারা এবং তোমাদের বক্তব্য দ্বারা।”

নবীজী সা. তার নিজের সম্পর্কে অনেকগুলো কথা বলেছেন। তা এ মুহূর্তে না বললেই নয়। তিনি সা. বলেছেন, “আমি তো অভিশাপ দেবার জন্য আসিনি। এসেছি রহমত হিসেবে।”

৪৫। ইমাম আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু হাল : মুসনাদু আহমাদ, খ. ২, পৃ. ৪৩৮

৪৬। ইমাম মুসলিম: ছহীহ মুসলিম, খ. ২, পৃ. ১০

‘উমার রা. এর সামনে একবার রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “খৃষ্টানরা মারয়াম পুত্র ঈসা আ. এর অতিপ্রশংসা করেছে। তোমরাও আমার অতিপ্রশংসা করো না।”

জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, আমি নবীজীকে বলতে শুনেছি, তিনি সা. বলেছেন, “তোমাদের কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু (খলীল) বানানোর অভিযোগ থেকে আমি আল্লাহর দরবারে মুক্ত। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুতো আল্লাহই হয়েছেন। যেমনিভাবে ইবরাহীম আ. -এর অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েছেন আল্লাহ। হ্যাঁ, যদি আমার উম্মত থেকে কাউকে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাতাম,, তাহলে আমি আবূ বাকার রা.-কে খলীল বানাতাম।”৪৭

তিনি সা. আরো ইরশাদ করেন, “একটি কথা ভালভাবে শুনে রাখ- তোমাদের পূর্বে যেসব জাতি এসেছে, তারা তাদের নবীদের কবরকে সিজদার স্থান হিসাবে গ্রহণ করেছে। সাবধান! কবরসমূহকে সিজদার স্থান করো না। আমি অবশ্যই এসব থেকে কড়াভাবে নিষেধ করছি।”৪৮

৪৭। ইমাম মুসলিম: ছহীহ মুসলিম, খ. ৫, পৃ. ১৩

৪৮। পূর্বোক্ত

নবীজীর (সা.) সন্তান বাৎসল্য :

নবীজীর যুগের আগের কথা। নবীজী জীবনের শুরু দিকেরও কথা। সেই সময়কে বলা হয় জাহিলী যুগ। অন্ধকার আর মূর্খতার যুগ। সেই সময়ে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া কী যে কষ্টের ছিল, তা আর বলার অপো রাখে না। আজকের বাবারা তুলনামূলক মেয়েদেরকে বেশী আদর করে। আর সেই সময়ে বাবারাই ছিলো মেয়েদের প্রধান শত্র“। মেয়ে জন্মের পর বাবাদের মুখ কালো হয়ে যেতো। কারো কাছে মেয়ে জন্মের কথা বলতে মুখ শুকিয়ে যেতো। মেয়ে জন্ম দেয়ায় নিজেকে দাঁড় করাতো লজ্জাজনক কাজ সম্পাদনকারীদের কাতারে। ক্ষোভে আর লজ্জায় শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকেই মেরে ফেলতো। জীবন্ত কবর দিত। আর কিছু না করলেও মেয়েটিকে দেখলেই মুখ ভার করে রাখতো।

সে যুগে ওয়াহ্শী (হিংস্র) নামক এক লোক ছিল। যেমন নাম, তেমন তার কাম। তার একটি মেয়ে হল। মেয়েটিকে সঙ্গে সঙ্গে সে হত্যা করল না। ধীরে ধীরে মেয়েটি বড় হল। এখন সে আব্বু আব্বু বলে ডাকতে পারে। বাহির থেকে তার আব্বু এলে দৌড়ে গিয়ে কোলে উঠতে পারে। মিষ্টি মিষ্টি চেহারা। বাবার ভাল লাগার মতোই মেয়ে। বয়স মাত্র ৬ বছর।

হঠাৎ ওয়াহ্শীর মনে কি যেন উদয় হল। ভাবান্তরে পড়ে গেল। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। কোদাল বেলচা হাতে নিয়ে চলল ময়দানে। সেখানে গিয়ে একটি গভীর গর্ত খনন করল। গর্ত খুড়ে চলে এল বাড়ীতে। ডাকলো তার স্ত্রীকে। বলল, তোমার মেয়েকে ভাল করে সাজিয়ে দাও। তাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। মা তার মেয়েকে খুব ভাল করে সাজিয়ে দিল।

মেয়ে চলছে তার বাবার সাথে। মেয়ের আনন্দ আর ধরে না। বেড়াতে যেতে কার না ভাল লাগে?

যেতে যেতে পৌঁছলো তারা সেই গর্তের কাছে। ওয়াহশী মেয়েকে দাঁড় করালো এর কিনারায়। মেয়েকে বলল, দেখতো-এর ভিতর কি আছে? মেয়ে এগিয়ে যায় তা দেখার জন্য। মাথা ঝুঁকিয়ে দেয় গর্তের দিকে। অমনি পাষন্ড বাবা তার মেয়েকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় গর্তে।

মেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে: বাবা! আমি গর্তে পড়ে গেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি তোল। আমার ভীষণ ভয় করছে। বাবা! বা-বা! আ-মা-কে তো-ল।’ মেয়ের ডাকের জবাবে বাবা দ্রুত মাটি ফেলতে থাকে গর্তে। ডাক আসে, ‘বাবা! আমাকে উঠাও।’ আরো দ্রুত মাটি ফেলতে থাকে ওয়াহশী। ধীরে ধীরে ভরে যায় গর্ত। মেয়ের চিৎকার আর ‘বাবা’ ডাকও এক সময় হারিয়ে যায় মরু ময়দানের সেই গর্তে। ওয়াহশী যেন একটা ভাল কাজ করতে পেরেছে- সেই গর্ব নিয়ে ফিরে আসে বাড়ীতে।৪৯

এমনই যুগের কথা বলছি। সেই সময়েই নবীজী সা. এ পৃথিবীর বুকে এলেন। সম্মানিত করলেন নারী জাতিকে। নারী মর্যাদা পেলো বোনের, মর্যাদা পেলো স্ত্রীর, মর্যাদা পেলো মায়ের, খালার, ফুফুুর। মেয়েরা হলো আদরের কন্যা, ভগ্নি, ভাতিজী। মেয়েরা পেলো নবীজীর ভালবাসা সবচেয়ে বেশী। নবীজী সা. যখন তার কন্যা ফাতিমা রা. এর কাছে আসেন, তখন তিনি ফাতিমার হাতটি ধরে তাতে চুমু বসিয়ে দেন। নিজের জায়গা থেকে সরে নিজের স্থানটিতে আদর করে মেয়েকে বসান। ফাতিমা রা.ও রাসূলে কারীম সা.-এর জন্য পাগলপারা। নবীজী যখন তার বাড়ীতে যান, সঙ্গে সঙ্গে তিনি দাঁড়িয়ে যান। নবীজীর হাত ধরে হাতে চুমু দেন আর তার নিজের বসার স্থানে নবীজীকে বসান।”৫০

রাসূলুল্লাহ সা. শুধু নিজের মেয়েকে আদর করেন এমন নয়। অন্যদের আদর করতে উৎসাহিত করেন। ‘আয়িশা রা. জানালেন, আমার কাছে এক মহিলা এলেন। তার সাথে ছিল তার দুই মেয়ে। সে আমার কাছে কিছু চাইলো। আমার কাছে তাকে দেয়ার মতো একটি খেজুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এটাই তাকে দিয়ে দিলাম। সে তা গ্রহণ করল। তারপর এ

৪৯। আবুল হাসান ‘আলী নদবী : আসসীরাতুন নববিয়া, পৃ. ৪৭-৪৮

৫০। আল্লামা শিবলী নু‘মানী ও সুলায়মান নদবী : সীরাতুন নবী, খ. ৬, পৃ. ১০৬

খেজুরটি দু’মেয়ের মাঝে বণ্টন করে দিল। তা থেকে নিজে খেল না। তারপর আমার কাছ থেকে উঠে পড়ল। তার দু’মেয়েকে নিয়ে চলে গেল। (কিছুণ পর) আমার কাছে নবী সা. এলেন। তার কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করলাম। সব শুনে নবী সা. বললেন-

যাকে কয়েকজন মেয়ে দেয়া হয়েছে। সে তাদের সাথে ভাল আচরণ করেছে। এ মেয়েরা দোযখ থেকে আত্মরার দেয়াল হবে তার জন্য।৫১

আনাস রা. বললেন, নবী সা. বলেছেন-

যে ব্যক্তি দু’টি কন্যা সন্তানকে লালন পালন করে বড় করল সে আমার সাথে মিলিত হয়ে কিয়ামত দিবসে উপস্থিত হবে। নবীজী তার দু’ আঙ্গুল একত্রিত করে মিলিত হওয়া দেখালেন।৫২

রাসূলুল্লাহ সা. এর মেয়ে ফাতিমা বিশ্বের সেরা চার মহিলার একজন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন-

চার জন বিশ্বের সেরা নারী- ১. খাদীজা ইবনাতু খুওয়াইলিদ, ২. ফাতিমা ইবনাতু মুহাম্মাদ, ৩ ফির‘আউনের স্ত্রী আসিয়া, ৪. ‘ইমরানের মেয়ে মারয়াম।৫৩

হযরত ‘আয়িশা রা. বললেন-

৫১। ইমাম মুসলিম: ছহীহ মুসলিম, খ. ১৬, পৃ. ১৭৯

৫২। পূর্বোক্ত, খ. ১৬, পৃ. ১৮০

৫৩। আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবী শায়বা : মুছান্নাফু ইবনু আবি শায়বাহ

(লেবানন : দারুল ফিকর, ১৯৯৪), খ.৭, পৃ. ৫৩০

রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে ফাতিমা রা. এর কথা বার্তা-ই বেশী মিল। যখন ফাতিমা রা. নবী সা. এর কাছে আসেন তখন আওয়াজ দিয়ে উঠেন। মারহাবা! মারহাবা বলেন। তার দিকে উঠে যান। তার হাত ধরে তাতে চুমু দেন। আর তার নিজের স্থানেই বসিয়ে দেন। ৫৪

নবী পরিবারের সদস্য ও নবীজীর জামাতা আলী রা. এর ব্যাপারে পর্দার আড়াল থেকেই জানলাম, ‘আয়িশা রা. জানালেন-

আল্লাহর কসম! রাসূলের কাছে পুরুষদের মাঝে আলী রা. এর চেয়ে প্রিয় আর কাউকে দেখিনি। আর মেয়েদের মাঝে তার স্ত্রী ফাতিমার চেয়ে প্রিয় আর কেউ ছিল না নবীজীর কাছে।৫৫

যখন কুফর আর তাওহীদের দ্বন্দ্ব দেখা দিল, যখন আয়াত নাজিল হল-

“আবূ লাহাবের ধ্বংস হোক।”৫৬ তখন নবীজী সা. -এর কন্যাদ্বয় নবীজীর ভালবাসার কারণেই আবূ লাহাবের দুই পুত্র উতবা ও উতাইবা-এর সাথে সম্পর্ক ছিন্নের জন্য প্রস্তুত হলেন। তারা হলেন নবীজীর

৫৪। আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আলহাকিম আননিসাবুরী :

আলমুসতাদরাক ‘আলাছ ছাহীহাইন, খ. ৪, পৃ. ১৩৮

৫৫। পূর্বোক্ত

৫৬। আলকুরআনুল কারীম : সূরাহ লাহাব, আয়াত ১

দু’কন্যা উম্মে কুলসুম ও রুকাইয়া রা.। নবীজী যখন ‘উতবা ও ‘উতাইবাকে দীনের দাওয়াত দিলেন, তখন ‘উতবা ও ‘উতাইবা নবীজীকেই দীনের দাওয়াত ছেড়ে দিতে বলল। ফলে বিরোধ চরমে পৌঁছে গেল। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল নবী পরিবারের সাথে। নবীজীর দু’কন্যার সাথে আবূ লাহাব পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন হল। নবীজীর কন্যাদ্বয় নবীজীর ভালবাসাকেই প্রাধান্য দিয়ে নবীজীর কাছে চলে এলেন।

নবীজী সা. তার কন্যাদের সাথে হাসি-খুশীভাবে মিশেন। তাদের চেহারা দেখেই মুখে ফুটে উঠে এক ঝলক হাসি। মনে বয়ে যায় আনন্দের ফোয়ারা।

‘আয়িশা রা. বলেন, আমরা নবীজীর স্ত্রীগণ একবার নবীজীর কাছে বসেছিলাম। ইতোমধ্যে হযরত ফাতিমা রা. নবীজীর কাছে এলেন। নবীজী যখন তাকে আসতে দেখলেন, তখন খোশ আমদেদ জানালেন। তিনি বললেন- স্বাগতম হে আমার মেয়ে। তারপর তার ডান বা বাম পাশে বসালেন।

একবার হযরত ফাতিমা রা. নবীজীর বাড়ীতে এলেন। উদ্দেশ্য হল-যাঁতা চালাতে গিয়ে তার হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে, এখন একজন সেবিকা প্রয়োজন। একথা নবীজীকে জানাবেন। কিন্তু দেখা গেল- তখন নবীজী সা. বাড়ীতে নেই। তাই অগত্যা ‘আয়িশা রা.-এর কাছে ব্যাপারটি জানিয়ে চলে গেলেন।

যখন নবী কারীম সা. বাহির থেকে এলেন, তখন ‘আয়িশা রা. ব্যাপারটি জানালেন নবীজীকে। ‘আলী রা. বলেন, খবর পেয়ে নবীজী সা. আমাদের বাড়ীতে এলেন। তখন আমরা বিছানায় শুয়েছিলাম। তাকে দেখে উঠে দাঁড়াতে চাইলাম। তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের স্থানেই থাক। বরং নবীজী আমাদের মাঝে এসে বসে গেলেন। নবীজীর পা’দ্বয়ের ঠান্ডা আমার বুকে অনুভব হতে লাগল। তখন তিনি বললেন, তোমাদেরকে এর চেয়ে ভাল কোন পথ দেখাব কি- যা একজন চাকর থেকেও উত্তম হবে? তা শুন, যখন তোমরা (দিনের কান্তি শেষে) বিছানায় শুইবে তখন সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদু লিল্লাহ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার ৩৩ বার বলবে। এটা একজন চাকর থেকেও উত্তম।৫৭ (এ তাসবীহকে ‘তাসবীহে ফাতিমী’ বলে। তা পড়ার দ্বারা শরীরের কান্তি দূর হয়ে যায়। ফলে একা একাই অনেক কাজ করার সুযোগ হয়।)

রাসূল সা. তার সন্তানাদিকে ভালবাসেন। তাদেরকে জড়িয়ে রেখে পান শান্তি। এ শান্তি যেন জুড়ে আছে তার পুরো পরিবারে। একবার তার পরিবার লোকদেরকে জড়ো করলেন এক তাবুর নীচে। হ্যা সে কথাটি জানলাম ‘আয়িশা রা. থেকে। তিনি বললেন-

রাসূলুল্লাহ সা. কালো পশমী কাপড়ের তাবু বানিয়ে নবী কারীম এক সকালে বাহিরে দাড়িয়ে থাকলেন। এর মধ্যে হাসান ইবনু আলী রা. এলেন। নবীজী তাকে এ তাবুতে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর এলেন হুসাইন রা.। তাকেও প্রবেশ করালেন। তারপর এলেন ফাতিমা রা. এবার তাকেও তাবুতে নিয়ে নিলেন। তারপর এলেন ‘আলী ইবনু আবি তালিব রা.। নবী আকরাম তাকেও তাবুতে নিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আহলে বাইত-তোমাদের থেকে ময়লা-অপবিত্রতা সরিয়ে দিয়ে তোমাদেরকে পরিপূর্ণ পবিত্র করতে চান।৫৮

৫৭। ইমাম মুসলিম: ছহীহ মুসলিম, খ. ১৭, পৃ. ৪৫

৫৮। পূর্বোক্ত, খ. ১৫, পৃ. ১৯৪

রাসূলুল্লাহ সা. এর মাঝে আমাদের জন্য রয়েছে আদর্শ। তিনি কখনও বিপদে ধৈর্যহারা হননি। হা-হুতাশ করেননি। নবীজীর চোখের সামনেই তিন ছেলে ইন্তিকাল করেন। তার জীবদ্দশায় ফাতিমা রা. ছাড়া তিন মেয়েও ইন্তিকাল করেন। এতদসত্ত্বেও কখনই তিনি হতাশায় গা চাপড়াননি। তার কাপড় ছিড়ে ফেলেননি। কোন শোকসভা করেননি। বরং তিনি সর্বদা থেকেছেন ধৈর্যশীল, শান্ত এবং আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী :

১। আল কুরআনুল কারীম

২। মুফতী মুহাম্মাদ শাফী’ : মা‘আরিফুল কুরআন (করাচী ,ইদারাতুল মা‘আরিফ, ১৯৯৬)

৩। মুহাম্মাদ ইবনু ইসমা‘ঈল: ছহীহ আলবুখারী (বৈরূত আলমাকতাবাতুছ ছাকাফিয়া, তা. বি.)

৪। ইমাম মুসলিম : ছহীহ মুসলিম (লেবানন : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়া ১৯৯০/১৪১১)

৫। ইমাম মুসলিম : ছহীহ মুসলিম (ভারত : মুখতার এন্ড কোম্পানী, তা. বি.)

৬। আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ : সুনানু আততিরমিযী (বৈরূত: বিন ‘ঈসা দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়া, তা. বি.)

৭। সুলাইমান ইবনুলআশ‘আছ : সুনানু আবী দাঊদ (মক্কা : দারুল বায, তা. বি.)

৮। ইমাম আবূ আব্দুর রাহমান : সুনানু নাসাঈ (হালব : মাকতাবুল আহমাদ ইবনু শু‘আইব ইলমিয়া ১৯৯৪)

আননাসাঈ

৯। ইমাম আবূ আব্দুর রাহমান : সুনানুল কুবরা লিননাসায়ী (লেবানন আহমাদ ইবনু শু‘আইব দারুল কুতুব আল‘ইলমিয়া, ১৯৯১)

আননাসাঈ

১০। মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযীদ : সুনানু ইবনু মাজাহ (লেবানন: দারু ইয়াহইয়াউত তুরাছ আল আরাবিয়া, ১৯৭৫)

১১। ইমাম আহমাদ ইবনু : মুসনাদু আহমাদ (লেবানন, দারু মুহাম্মাদ ইবনু হাল ইয়াহইয়াউত তুরাছ, ১৯৯৩)

১২। আবূ ‘আব্দুল্লাহ : আলমুসতাদরাক ‘আলাছ ছাহীহাইন মুহাম্মাদ ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (লেবানন : দারুল মা‘আরিফাহ, আলহাকিম আননিসাবুরী ১৯৯৮)

১৩। আবূ বাকার আহমাদ : শু‘আবুল ঈমান (লেবানন: দারুল ইবনুল হুসাইন কুতুব আল‘ইলমিয়া, ১৯৯০)

আলবাইহাকী

১৪। ‘আব্দুল্লাহ ইবনু : মুছান্নাফু ইবনু আবি শায়বাহ (লেবানন: মুহাম্মাদ ইবনু দারুল ফিকর, ১৯৯৪)

আবী শায়বাহ

১৫। আবূ মুহাম্মাদ : সুনানু আদদারামী (পাকিস্তন হাদীছ ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্দুর একাডেমী,১৯৮৪) রহমান আদদারামী

১৬। ওলীউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু : মিশকাতুল মাসাবীহ (বৈরূত : ‘আবদিল্লাহ আততিবরিযী আলমাকতাবাতুল ইসলামিয়া, ১৯৮৫)

১৭। যাকিউদ্দীন আব্দুল : আততারগীব ওয়াততারহীব (কায়রো : ‘আজিম ইবনু ‘আবদিল দারুল হাদীছ, ১৯৮৭)

কুওয়া আলমুনজিরী

১৮। আবূ বাকার আহমাদ : দালায়িলুন নুবুওয়াহ ইবনুল হুসাইন (লেবানন: দারুল কুতুব আলবাইহাকী আল‘ইলমিয়া, ১৯৮৫)

১৯। আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল : শামায়িলুর রাসূল (লেবানন : দারুল ইবনু কাছীর মা‘আরিফাহ, ১৯৬৭)

২০। শিহাবুদ্দীন হাইতামী : আশরাফুল ওয়াসাইল ইলা ফাহমিশ শামায়িল (বৈরূত : দারু কুতুবিল ‘ইলমিয়া, ১৯৯৮)

২১। আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ : আশশামাইলুল মুহাম্মাদিয়া (প্রকাশনীর বিন ‘ঈসা নাম উল্লেখ নেই, ২০০১)

২২। আহমাদ ইবনু হাজার : ফাতহুল বারী (বৈরূত : দারুর আল ‘আসক্বালানী রাইআনুত তুরাছ, ১৯৮৭)

২৩। আল্লামা শিবলী নু‘মানী : সীরাতুন নবী, (লাহোর : হুযায়ফাহ ও সুলায়মান নদবী একাডেমী, ২০০০)

২৪। আবুল হাসান : আসসীরাতুন নববিয়া (লাখনৌ : ‘আলী নদবী আলমাজমা‘উল ইসলামী আল‘ইলমী, তা. বি.)

২৫। ইবনু হাইআন : আখলাকুন নবী (রিয়াদ : দারুল মুসলিম, ১৯৯৮)

২৬। ডা.মুহাম্মাদ আব্দুল হাই :উসওয়ায়ে রাসূলে আকরাম (ঢাকা মুহাম্মাদিয়া কুতুব খানা,২০০৪)

২৭। আবূল ফিদা আলহাফিজ ইবনুল কাছীর :আলবিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৯৯৬)

২৮। মুহাম্মাদ ইবনু সা‘আদ : তাবাকাত কাবীর (হায়দারাবাদ : দারুত তাবা’ জামিয়া’ উছমানিয়া, ১৯৪৪)

২৯। ‘ইজ্জুদ্দীন আবূল হুসাইন আলী ইবনুল আছীর : আলকামিল ফিততারীখ (বৈরূত : দারু ছাদির, ১৯৯৫)

৩০। আবূ বাকার আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুসসুন্নী : আমালুল ইয়াওম ওয়া লাইলাহ (করাচীমাকতাবাতুশ শাইখ ১৪১২ হিজরী)

৩১। শাইখুল ইসলাম আবূ ‘আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু নাছর আল মারওয়াযী : কিয়ামুল লাইল (ফয়সালাবাদ : হাদীছ একাডেমী, ১৯৮২)

৩২। মুফতী যাইনুল ‘আবিদীন সাজ্জাদ মিরাঠী :তারীখে মিল্লাত (লাহোর : ইদারায়ে ইসলামিয়াত, ১৯৯১)