মুখপাত্র খুঁজে পাচ্ছে না বিএনপি
কথা বললেই গ্রেফতার!
তারেক সালমান ও কাজী জামশেদ নাজিম, দ্য রিপোর্ট : দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে একের পর এক গ্রেফতার হচ্ছেন দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মুখপাত্ররা। জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকেও আন্দোলন ঘোষণাকারীকে গ্রেফতারের অঘোষিত নির্দেশ রয়েছে।
মাত্র এক মাসের ব্যবধানে বিএনপির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেছেন দলটির ৮ কেন্দ্রীয় নেতা। এর মধ্যে ঘোষিত মুখপাত্র ছিলেন ২ জন, বাকিরা অঘোষিত, সংকটকালীন সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। মুখপাত্রের দায়িত্বপালনকারী ৩ নেতা এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। একজনকে আটকের পর ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, কার্যত এখন মুখপাত্র সংকটে বিএনপি। গ্রেফতার আর ক্ষমতাসীনদের হয়রানির অজুহাতে দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই এই দায়িত্ব এড়িয়ে চলছেন। ফলে একেক দিন একেকজনকে বিএনপির মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। দলটির মুখপাত্র ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৯ নভেম্বর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক গায়েবানা জানাজায় উপস্থিত হন। গ্রেফতার এড়াতে তিনি হেলমেট পরে একটি মোটরসাইকেলে করে আত্মগোপনে চলে যান ওইদিন।
প্রায় এক মাস আত্মগোপনে থাকার পর গত ৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সঙ্গে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার বৈঠকে উপস্থিত হন মির্জা ফখরুল। ওই দিন তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললেও পরে আর প্রকাশ্যে আসেননি। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গ্রেফতারের ভয়ে মির্জা ফখরুলের আত্মগোপনের কৌশলকে দলের দুর্বলতা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
ফখরুলের আত্মগোপনের পর গত ৯ নভেম্বর থেকে বিএনপির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছিলেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। নয়াপল্টনের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ থেকে প্রতিদিনই প্রেস ব্রিফিং করেছেন তিনি। গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন দলের কর্মসূচিকালীন সারা দেশের চিত্র। ৩০ নভেম্বর ভোররাতে পুলিশ পল্টন কার্যালয় থেকে তাকে গ্রেফতার করার পর কার্যালয়ের দায়িত্ব পান দলের আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু গ্রেফতারের ভয়ে তিনি ছিলেন আত্মগোপনে। ৩০ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ দফা অজ্ঞাতস্থান থেকে গণমাধ্যমে ভিডিওবার্তা পাঠিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভিডিওবার্তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার ঝড় ওঠে। এতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা। সাংগঠনিক ইমেজ হয় প্রশ্নবিদ্ধ।
এরপর গত ৮ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে নয়, গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গণি। পরে গত ১১ থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ দফা প্রেস ব্রিফিং করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এরও বেশ কয়েকদিন আগে থেকে নজরুল ইসলাম গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সেখান থেকেই ওই কয়দিন হাতে সালাইন পুশের ‘ক্যানোলা’ লাগিয়ে তিনি দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ বিফ্রিংয়ে আসেন।
গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে দলের ব্রিফিং করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ। প্রথম দিন ব্রিফিং শেষ করে প্রেস ক্লাব থেকে বের হওয়ার পরপরই তার গাড়িকে সিনেমা স্টাইলে ধাওয়া করে ডিবি পুলিশ। পরে ধরতে না পারায় ওই যাত্রায় তিনি গ্রেফতারের হাত থেকে রক্ষা পান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করার পরপরই তাকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। বর্তমানে তিনি কারাবন্দি।
এরপর গত ৩১ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন তার বারিধারার বাসা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরে ৭ জানুয়ারি গ্রেফতার হন দলটির এই সিনিয়র নেতা। ওইদিন তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবে দুপুরে এক আলোচনা সভায় বক্তব্য দিয়ে বের হচ্ছিলেন। সেখান থেকে তাকে ডিবি পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। বর্তমানে কারাবন্দি এ নেতা মোকাবেলা করছেন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা।
একই দিন বিকেলের দিকে বারিধারা থেকে গ্রেফতার করা হয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন এবং সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদকে৷ তখন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, দুই এমপি আশরাফ উদ্দিন নিজান ও হারুন উর রশীদ এবং মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদিকা শিরিন সুলতানাকে আটক করা হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়৷ ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর গভীর রাতে ছেড়ে দেওয়া হয় নাজিম উদ্দিন আহমেদকে।
গত ১ জানুয়ারি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান তার গুলশানের বাসায় প্রেস ব্রিফিং করে সারা দেশের অবরোধ চিত্র তুলে ধরেন। এর আগে গুলশানের বাসায় গৃহবন্দি দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে দেখতে গেলে আটক হন তিনি। পরে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু মঙ্গলবার ১৮ দলীয় জোটের হরতাল ১২ ঘণ্টা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর গুলশানের বাসা থেকে তাকেও গ্রেফতার করা হয়।
গত ২ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক তার গুলশানের বাসায় প্রেস ব্রিফিং করে অবরোধ কর্মসূচির সারা দেশের চিত্র তুলে ধরেন। পরের দুদিনও তিনি তার বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু গ্রেফতার আতঙ্কে ড. ফারুক গত বৃহস্পতিবার রাতে ভিডিওবার্তার মাধ্যমে রবিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এরপর তিনি আর প্রকাশ্যে আসেননি।
এরপর কর্মসূচি ঘোষণা বা স্থগিতের ঘোষণা আসছে দলের আত্মগোপনকারী ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, কখনও দলের সহ-দপ্তর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম আবার কখনও বা সহ-দপ্তর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীনের নামে; প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।
দলীয় পদ-পদবিতে অধিষ্ঠিত নেতাদের আত্মগোপন ছাড়াও দীর্ঘদিন ‘প্রকাশ্যে’ আসেন না বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সেক্রেটারি মারুফ কামাল খান সোহেল। তার মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় বিএনপি বিটে কর্মরত সংবাদকর্মীরা সব ধরনের যোগাযোগ থেকে কার্যত: বিচ্ছিন্ন ও অন্ধকারে পড়েছেন। চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের দুই সহযোগী শায়রুল কবির খান ও শামসুদ্দিন দীদারের কাছ থেকে সংবাদকর্মীরা সহযোগিতা পাচ্ছেন।
দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সরকার সামনের দিনগুলোতে আরও হার্ডলাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন সরকার গঠনের পর প্রতিদিনই গ্রেফতার তালিকায় যোগ হচ্ছে বিএনপির অনেক নেতার নাম।
এই বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল বা জোট বিভিন্ন দাবি আদায়ে আন্দোলন কর্মসূচি দিয়ে আসছে। তবে এই সময় একটি বিশেষ গোষ্ঠী পেট্টোল বোমায় সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্যদের পুড়িয়ে মারছে। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ মানুষ হত্যার কোনো সুযোগ দেবে না।’
বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার সম্পর্কে মনিরুল বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নয়, সহিংসতা বা নাশকতার মদদ দিয়ে যারা উস্কানিমূলক বক্তব্য দেবে তাদেরকেই গ্রেফতার করা হবে। সেক্ষেত্রে কে কোন দলের কি পদ বহন করছে তা বিবেচনা করা হবে না। তিনি বলেন, প্রতিটি মানুষের রাজনৈতিক দাবি বা কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা উচিত। যদি কেউ পুলিশ বা সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে সহিংসতা শুরু করে ডিএমপি পুলিশ তাদের ছাড় দেবে না।’
‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ঘোষণার দুদিন পর, ২৬ ডিসেম্বর থেকেই গুলশানের বাসভবনে কার্যত: ‘গৃহবন্দি’ হয়ে পড়েন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তারপর থেকে দফায়-দফায় গ্রেফতার করা হচ্ছে কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাদের। দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারাও এড়াতে পারছেন না গ্রেফতার। সার্বিক পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, বিএনপির পক্ষ হয়ে সরকারের সমালোচনা দূরে থাক, গণতান্ত্রিক আন্দোলন কর্মসূচি যারাই ঘোষণা করছেন, তাদেরকেই হতে হচ্ছে গ্রেফতার। এমন ঘটনাও আছে কর্মসূচি ঘোষণার পর ঘণ্টাখানেক সময়ও হাতে পাননি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা, এরইমধ্যে গ্রেফতার হয়ে তাদেরকে হতে হয়েছে কারাবন্দি।
জানা গেছে, গত ২৫ অক্টোবরের পর থেকেই বিএনপিকে ধীরে-ধীরে কারাবন্দি করার কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। সেই কৌশলের সফল বাস্তবায়নও করেছে তারা। ২৫ অক্টোবরের পর বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারণী ও সিনিয়র নেতাকে কারাবন্দি করা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা ও মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, মীর নাসির উদ্দিন, বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকনসহ মোট ২২ জন কেন্দ্রীয় নেতা। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসও কারাবন্দি। কারাবন্দি আছেন বিএনপির ১১ অঙ্গ-সহযোগি সংগঠনের একাধিক শীর্ষ নেতা।
(দ্য রিপোর্ট/টিএস-কেজেএন/এইচএসএম/জানুয়ারি ১৪, ২০১৪)