বাবার মৃত্যুর ছবি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানোর পর থেকে ক্যামেরার সামনে যায় না ছোট্ট মনীষা। নতুন পোশাক আন্দোলিত করে না তাকে। চঞ্চল প্রকৃতির মনীষা মুষড়ে পড়ে বাবার ছবি হাতে নিয়ে। বুঝতে পারে না তার বাবা কোথায় গেছে। প্রায় দু’বছর বাবাকে দেখে না সে। চুপি চুপি বাবার ছবির সঙ্গে কথা বলে কাজী মনীষা মল্লিকা। সে জানে না পুঁজিবাজার কেড়ে নিয়েছে তার বাবার প্রাণ। কোথায় গেছে বাবা? এমন প্রশ্নের জবাবে সাড়ে ৫ বছরের ছোট্ট মনীষা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলে ‘আল্লাহর কাছে গেছে।’

দেশের পুঁজিবাজারে সংঘটিত ২০১০ সালের ভয়াবহ ধস শুধু মনীষার বাবার জীবন কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে আরও ৮ প্রাণ। জীবনের চেয়ে পুঁজি হারানোর বোঝা বেশি ভারি ছিল তাদের কাছে। ধসের পর একটানা দর পতনের স্রোতে সর্বস্ব ভেসে গেছে তাদের। চেয়ে চেয়ে দেখেছেন জীবনের সঞ্চিত পুঁজির অতলে তলিয়ে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নটুকুও ম্লান হয়। একে একে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ৯ জন হতভাগ্য বিনিয়োগকারী।

ভয়াবহ ধসের পর জীবনের সঞ্চিত পুঁজি হারানোর বোঝা বইতে না পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩ জন বিনিয়োগকারী। আর লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ৬ জন। যাদের কারণে দেশের পুঁজিবাজারে ঘোর অমানিষা নেমে এসেছিল তাদের একজনেরও শাস্তি হয়নি। হতভাগ্যদের জন্য আর্থিক সাহায্যের দাবি উঠলেও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানই তাতে সাড়া দেয়নি।

২০১২ সালের ৩০ জানুয়ারি লিয়াকত আলী যুবরাজ (৩৫) ঘরের দরজা বন্ধ করে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। পিতৃহারা হয় ছোট্ট শিশু মনীষা। যুবরাজ ঢাকার ৬৪/জে/৬ গোপীবাগ, আরকে মিশন রোডের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। পুঁজিবাজার যখন ফুলে ফেঁপে উঠেছিল তখন তিনি ব্যাংক থেকে প্রায় ৮০ লাখ টাকা ঋণ নেন। নগদ টাকাসহ মোট পুঁজির পরিমাণ দাঁড়ায় দেড় কোটি। ভয়াবহ ধসের পরও দীর্ঘ দর পতনের কারণে তার মূলধন ঋণাত্মক (মাইনাস ইক্যুইটি) হয়ে যায়। ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চিন্তা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় দিনমান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বিষণ্নতায় ভুগছিলেন বলে তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার সাথী জানান।

‘এখন মেয়েকে ঘিরেই আমার জীবন। বাবা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় স্বামীর মৃত্যুর পর ভেবেছিলাম সরকারের সহযোগিতা পাব। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেননি।’ দ্য রিপোর্টের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ সব কথা বলেন যুবরাজের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার সাথী। পুরুষ শাসিত সমাজে স্বামী না থাকায় ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি প্রায়ই ভেঙ্গে পড়েন। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অফিসে থাকার কারণে মেয়েকে সময় দিতে পারেন না। তবে ছুটির দিন মনীষাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান সাথী।

যুবরাজের আত্মহত্যার পরের দিন অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি ঢাকার শান্তিনগরে শাহাদাৎ নামের এক বিনিয়োগকারী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি ভয়াবহ ধসের কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন বলে পরিবার সূত্রে জানা যায়।

সহায় সম্বল হারিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রামের বিনিয়োগকারী দিলদার হোসেন (৫৬)। পুঁজিবাজারে কয়েক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন দিলদার। অব্যাহত দর পতনের কারণে তার প্রায় সব টাকাই খোয়া যায়। এতে দিলদার হোসেন ভেঙ্গে পড়েন। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর আসকারদিঘীর পশ্চিম পাড়ে জনৈক রেজ্জাকুল হায়দারের বাড়ির ৪ তলায় ভাড়া থাকতেন।

পুঁজিবাজার ধসের কারণে বড় ধরনের লোকসানে পড়েন সিলেটের বিনিয়োগকারী সামসুল হক সরদার ওরফে শাহিন। ২০১২ সালের ২৯ মার্চ প্যান্টের বেল্ট দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। সিলেটের অভিজাত বিপণিবিতান সিটি সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন শাহিন। ঘটনার দিন বিকেলে সিলেট নগরীর জালালাবাদ আবাসিক এলাকার ৩৫/৫ নম্বর বাসার ৩য় তলার শয়নকক্ষের জানালার গ্রীলের সঙ্গে ঝুলানো অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

পুঁজিবাজারে কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে বরিশালের মাসুক উর রহমান সুমন (৩৬) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ভয়াবহ ধসের পর একটানা দর পতনের কারণে তিনি মুষড়ে পড়েন বলে পরিবার সূত্রে জানা যায়।

জীবনের চেয়ে লোকসানের বোঝা বেশি ভারি হওয়ায় ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর বিনিয়োগকারী মফিজুল ইসলাম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ঘটনার দিন ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনি রাজধানীর র‌্যাপিড সিকিউরিটিজ হাউজে ২০১০ সাল থেকে লেনদেন করতেন। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। পরিবার পরিজন ছেড়ে তিনি শুধু শেয়ার ব্যবসার জন্য ঢাকায় তার বন্ধু রেজাউল করিমের সঙ্গে মেসে থাকতেন।

বিনিয়োগকারী মফিজুল ইাসলাম দীর্ঘদিন দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিলেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে জমানো ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ২০১০ সালে শেয়ার ব্যবসা শুরু করেন। শুরুতে কিছুটা মুনাফা করলেও ভয়াবহ ধসের পর তার পত্রকোষের (পোর্টফলিও) এক তৃতীয়াংশ লোকসানে চলে যাওয়ায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বলে তার বন্ধু রেজাউল করিম জানান।

পুঁজিবাজারে লগ্নিকৃত অর্থ হারিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর মাজহারুল হক (৩৫) নামের এক বিনিয়োগকারী ভৈরব পৌর এলাকায় রানী বাজারে নিজ বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি এবি ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন।

(দ্য রিপোর্ট/আরএ/ডব্লিউএন/এএল/এইচএসএম/জানুয়ারি ১৫, ২০১৪)