উন্নয়ন প্রকল্পে অনুমোদনহীন অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা বাড়ছে
আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলার পরিপন্থী হলেও উন্নয়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রবণতা বাড়ছে। এই অবস্থা নিয়ম বহির্ভূত বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। গত অর্থবছর ও চলতি অর্থবছরে এ রকম বেশ কিছু প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের এ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। যেখানে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থব্যয় করা হয়েছে অথবা ডিপিপিতে (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) অনুমোদিত কাজের বাইরে খেয়াল খুশি মতো কাজে টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, এই রকম প্রকল্প মাঝে মাঝে পাওয়া যাচ্ছে। এটি অবশ্যই আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এই বিষয়ে আগে ইচ্ছে মতো অর্থ ব্যয় করে পরে অনুমোদন নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক হওয়া দরকার।
পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এরকম প্রকল্পের ক্ষেত্রে ঘটনাউত্তর অনুমোদন দিতে গিয়ে এর আগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, এরকম ঘটনা যেন না ঘটে সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) দায়িত্বশীলদের মতে, এক কাজে দেওয়া বরাদ্দ অন্য কাজে খরচ করা হবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এই ধরনের সুযোগ দিলে যে উদ্দেশ্যে প্রকল্প নেওয়া হবে সে উদ্দেশ্য কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হবে না। তাই এই ধরনের সংস্কৃতি যাতে গড়ে উঠতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, একটিভেটিং ভিলেজ কোর্ট ইন বাংলাদেশ শীর্ষক প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে ২০১১ সালে সংশোধনীর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে আসে। পরিকল্পনা কমিশন পর্যালোচনা করে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে বলেছিল যে, অনুমোদিত প্রকল্পের কাজটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য ৫১ কোটি ৯৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয়ে ৫০০ জন ফিল্ড ওয়ার্কার এবং ৫০০ জন কোর্ট এসিস্ট্যান্ট নিয়োগের সংস্থান ছিল। সংশোধিত প্রকল্পে এ দুটি পদের জনবল বাদ দিয়ে কাজগুলো এনজিওর মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি প্রকল্প অনুমোদনের পর প্রধান অঙ্গের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে নতুন আঙ্গিকে কার্যক্রম মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। এছাড়া অনুমোদিত প্রকল্পে সরবরাহ ও সেবা খাত নামে কোনো অঙ্গ এবং এ খাতে কোনো বরাদ্দ নেই। অথচ আরটিপিপিতে (সংশোধিত কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদিত টিপিপি অনুযায়ী এ অঙ্গ দেখিয়ে এর ব্যয় দেখানো হয়েছে ২১ কোটি ৪০ লাখ ২২ হাজার টাকা। কিন্তু টিপিপিতে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত এ অঙ্গের ব্যয় ৪ কোটি ১৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে এবং ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত হয়ত আরো অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। অননুমোদিত অঙ্গে অর্থ ব্যয় আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলা পরিপন্থী। এ অঙ্গের ব্যয় ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রকল্পটিতে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৮ কোটি ৮১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদিত টিপিপি বহির্ভূতভাবে অনুমোদনহীন অঙ্গে ব্যয় করা হয়েছিল সরবরাহ ও সেবা খাতে ৪ কোটি ১৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, মুদ্রণ ও প্রকাশনা খাতে ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা, স্টেশনারি ও সিল খাতে ৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, বিবিধ খাতে ৭ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকাসহ মোট ৫ কোটি ৮ লাখ ২৩ হাজার টাকা এবং অনুমোদিত টিপিপি সংস্থানের অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে অফিস ভাড়া ২৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। অনুমোদন বহির্ভূত এসব ব্যয় ভূতাপেক্ষ অনুমোদন সম্ভব নয় বলে মত দিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন। এ ছাড়া অনুমোদিত প্রকল্পে এনজিও নিয়োগের কোন সংস্থান ছিল না। আরটিপিপিতে দেখা যায় যে, ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে এনজিও নিয়োগ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এসব ব্যয় অনুমোদন দেওয়া যায় না। এ প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হলে এ প্রকল্পটি সংশোধনী প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় পরিকল্পনা কমিশন।
অন্যদিকে সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী প্রকল্পটিতে বরাদ্দ রাখা হয় ১ হাজার ১৩৩ কোটি ৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা। কিন্তু অতিরিক্ত খরচ করা হয় ৭৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা । এমনকি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর দরকার হলে বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে অনুমোদনের জন্য আবেদনের নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, পরামর্শক, যন্ত্রপাতি মেরামত এবং ভাতা দেওয়ার কথা বলে এই টাকা খরচ করা হয়েছিল। এই খাতগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণ যথেষ্ট ছিল। তাছাড়া অন্য খাতে বাড়লেও এই খাতে পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকার কারণে কোনোভাবেই ব্যয় বাড়ার কথা নয়। এজন্য ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (ইজিসিবি) দাবি অযৌক্তিক বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, বিদ্যুৎ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) খাতে এই ধরনের ঘটনা খুব বেশি ঘটছে। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এটি করতে না পারলে থমকে যাবে উন্নয়ন কাজ। নিয়ম বাহির্ভূত খরচ করার বিষয়ে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে। যদি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে তাহলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় খরচ দেখানোর সুপারিশ করা হবে। আর সন্তোষজনক না হলে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে ব্যয় বহন করতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হতে পারে।
সূত্র জানায়, প্রথম সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) মূল্য বৃদ্ধির কারণে ৬৭ লাখ টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য বলা হয়। কিন্তু সেই জায়গায় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল ১১২ কোটি টাকা। যা সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে (জিওবি) । যদিও বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট এই প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির অর্থ এডিবি’র বহন করার কথা। কোনোভাবেই এই ধরনের প্রকল্পে সরকারি অর্থ ব্যয় করা যাবে না। কিন্তু সেটি না করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ১১২ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। এডিবি’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, প্রকল্পটি সমাপ্ত পর্যায়ে, এজন্য ব্যয় বৃদ্ধির কোনো খরচ এডিবি বহন করবে না। আর তাই সরকারকে ১১২ কোটি টাকা ব্যয় বহন করতে হবে।
(দ্য রিপোর্ট/জেজে/এইচএসএম/এনআই/জানুয়ারি ১৫, ২০১৪)