বহুল আলোচিত ও সমালোচিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করল আওয়ামী লীগ। প্রায় একইভাবে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ‘জয়ী’ হয়ে বিএনপিও দ্বিতীয়বার মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল। ১৮ বছরের ব্যবধানে গঠিত দুটি সরকারের মধ্যে পার্থক্য হল, বিএনপি সরকার গঠন করেই পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিজেকে ‘জনপ্রিয়’ সরকার হিসেবে ভাবছে। নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি আহ্বান সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি পাঁচ বছরের সরকার।

মন্ত্রিসভা গঠন হওয়ার পর থেকে গণমাধ্যমে দেওয়া সরকার ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের প্রতিক্রিয়া থেকে তাদের আত্মবিশ্বাসের বিষয়টি পরিষ্কার হয়।

বাণিজ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, সরকার স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে। একই সঙ্গে বিএনপির সঙ্গে আলোচনাও চালাবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, সরকার পাঁচ বছরের জন্য গঠিত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ দ্য রিপোর্টকে বলেন, আওয়ামী লীগ বরাবরই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ ভোট পায়। এবার বিরোধী দলের নাশকতা সত্ত্বেও ৪০% ভোটার ভোট দিয়েছেন। অন্যবার এই পরিমাণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলে যদি সরকার গঠনে সমস্যা না হয় তাহলে এবার একই পরিমাণ ভোট পেয়ে জনপ্রিয় হতে বাধা কোথায়?

এদিকে এই নির্বাচনে ভোট পড়ার (কাস্টিং) হার নিয়েও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং এ্যালায়েন্স (ফেমা)-এর তথ্য অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে ভোট পড়েছে শূন্য থেকে ১০ শতাংশ। অন্যদিকে ব্রতী নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী এই হার ৩৭.৫ শতাংশ। প্রধান দুই দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বেলায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণে এত ফারাক থাকে না।

নির্বাচন নিয়ে খোদ সরকারি দলের মধ্যে ভেতরে ভেতরে সমালোচনা আছে। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের অনড় অবস্থানের কারণে মুখ খুলে কিছু বলছেন না কেউ।

সদ্য সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার বাসায়। এমন সময় তার নির্বাচনী এলাকা থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন সরকারি কর্মচারী আসেন। ঘরোয়া কথপোকথনে জানা গেল, তিনি এবারের নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার কেন্দ্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ভোটার ছিল ৫৮০ জন। মোট ভোট পড়েছে ৭০টি। আর কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ফলাফল পাঠিয়েছেন একটু বাড়িয়ে। কত বাড়িয়ে পাঠিয়েছেন সেটা বলতে চাননি। কারণ ততক্ষণে তিনি জেনে গেছেন, এই প্রতিবেদক একজন সাংবাদকর্মী।

অন্যদিকে এই নির্বাচনে হতাশা প্রকাশ করেছে পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সব দেশ। ভারত ও রাশিয়া ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য দেশের পক্ষ থেকে নতুন সরকারকে অভিন্দন জানানো হয়নি। কূটনীতিকরা দ্রুত গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের বিষয়ে তাদের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। আলোচনার কথা বলা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকেও। অবশ্য এসব কথার উত্তরে সরকার তার পুরনো কৌশলে উত্তর দিচ্ছে। বলছে, ‘আলোচনা হবে’ ‘আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাই।’

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরুর দুই দশকের মধ্যে এবার দ্বিতীয়বারের মতো পর পর দুইবার মন্ত্রিসভা গঠন করল কোনো দল। প্রথমবার বিএনপি সরকার গঠন করে টিকতে পারেনি। এবার আওয়ামী লীগ সরকার কী করে সে বিষয়ে নানা পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ করছেন বিশ্লেষকরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, এমন নির্বাচন করে অতীতেও জনপ্রিয়তার পরীক্ষা একটি দল দিয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। হয়তো একটু সময় লাগবে।

১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের বিস্তারিত তথ্য নির্বাচন কমিশনে পাওয়া যায় না। কিন্তু মানুষের মনে ঠিকই এর হিসাব-নিকাশ পাওয়া যায়। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের হিসাব কী হয় সেদিকেই নজর এখন সবার।

(দ্য রিপোর্ট/ বিকে/ এইচএসএম/ এনআই/জানুয়ারি ১৫, ২০১৪)