দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী সানাউল্লাহ চৌধুরী তার সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।

বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। সাক্ষীকে সহোযাগিতা করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন।

সাক্ষীর জবানবন্দী পেশ করার পরে জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় মামলার কার্যক্রম আগামী ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ধরে নিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। সে সময় আল বদর কমান্ডার মীর কাশেম আলী ওরফে বাংলা খান উপস্থিত থাকতেন।

সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের অফিস সহকারী ছিলেন। এবং উত্তর নালাপাড়া ডবলমুরিং থানার মুসলিম হাইস্কুলের শিক্ষক বশিরুল হুদার বাসায় ভাড়া থাকতেন।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের পর ভগ্নিপতি হাবিবুর রহমান, প্রতিবেশী জাফর, ইলিয়াস মিলে গল্প করছিলাম। এ সময় ৭/৮ জন অস্ত্রধারী ঘরে প্রবেশ করে তাদের চোখ বেঁধে ডালিম হোটেলের দোতলায় একটি রুমে আটকে রাখে।

সানাউল্লাহ চৌধুরী বলেন, ইলিয়াস অলীকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জানি না। চোখের বাঁধন কিছুটা হালকা করে দেখতে পাই, রুমের মেঝেতে আরো কয়েকজন চোখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে কাতরাচ্ছেন। এদের মধ্যে উত্তর নালাপাড়ার অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম, শাহ আলম, হাজারি গলির টুনটু সেন, রঞ্জিৎ দাশ ছিলেন।

সাক্ষী বলেন, এর কিছুক্ষণ পর তাকে ডালিম হোটেলের তিনতলার একটি রুমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর আল বদরের লোকেরা চলে আসার পর চোখের বাঁধনটি আবারো হালকা করার পর সেখানে কদমতলীর জাহাঙ্গীরসহ আরো কয়েকজনকে দেখতে পাই।

এর কিছুক্ষণ পর রুমে একটি লোককে ধরে নিয়ে এসে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে যায়। লোকটি তখন কান্নাকাটি করছিল। কান্নাকাটি শুনে সাক্ষী বুঝতে পারেন লোকটি তার পূর্ব পরিচিত অ্যাডভোকেট শফিউল আলম।

সাক্ষী বলেন, পরদিন উপরতলা থেকে নির্যাতনের শব্দ পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা বুঝতে পারি, কোনো একজনকে আমাদের রুমে নিয়ে আসা হয়েছে। তখন কেউ একজন কয়েকজন আল বদরকে কমান্ড করে বলছিল, ‘এই শালা মরেনি, ওকে ছুঁড়ে ফেলে দাও। যাতে এই রুমে যারা আটক আছে তারা বুঝতে পারে সত্য স্বীকার না করলে তাদের কি অবস্থা হতে পারে।’ ছেলেটিকে আমাদের রুমে ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে যায়।

তখন শফিউল আলম আমাকে কানেকানে বলেন, ‘ইনি মীর কাশেম আলী, বাঙালি খান, বদর বাহিনীর কামান্ডার।’

সাক্ষী বলেন, যে ছেলেটিকে তাদের রুমে রেখে চলে গেল অ্যাডভোকেট শফিউল আলম তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। তার অবস্থা এতটাই মুমূর্ষু ছিল যে, কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলেটি মারা যায়। এ সময় শফিউল আলমের কাছ থেকেই তিনি জেনেছিলেন, ছেলেটি সন্দ্বীপের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম। সন্ধ্যার পর জসিমের মৃতদেহ আল বদরের লোকেরা এসে নিয়ে যায় বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী।

সাক্ষী আরো বলেন, আল বদর ক্যাম্পে কাজ করত স্বপন নামের একটি ছেলে, সে তাদের জানায়, রাতে আল বদরদের নির্যাতনে মারা যাওয়া জসিম, টুনটু সেন ও রঞ্জিৎ দাশসহ ৪/৫ জনের লাশ কর্ণফুলীনদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। স্বপন তাদের আরো জানায়, এ ক্যাম্প থেকে যাদের যাদের নিয়ে যাওয়া হতো তারা আর ফিরে আসত না।

সাক্ষী জবানবন্দীতে বলেন, ডালিম হোটেলে আটক থাকা অবস্থায় প্রায়ই বিভিন্ন রুমে নিয়ে আমাকে নির্যাতন করা হতো। এই নির্যাতনের সময় মীর কাশেম আলী কখনো কখনো উপস্থিত থাকতেন ও জিজ্ঞাসাবাদ করতেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর দেবে এই শর্তে মুচলেকা দিলে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর সাক্ষী সানাউল্লাহ চৌধুরীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরেন।

সাক্ষীর জবানবন্দী শেষে তাকে সংক্ষিপ্ত জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় মামলার কার্যক্রম মুলতবি করা হয়। এ সময় আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন মীর কাশেম আলী। সাক্ষী তাকে শনাক্ত করেন।

এর আগে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর প্রথম জবানবন্দী পেশ করেন সৈয়দ মো. এমরান। তার আগে ৫ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১৩ সালের ১৭ জুন তাকে গ্রেফতার করা হয়।

(দ্য রিপোর্ট/এসএ/এসবি/ এনআই/জানুয়ারি ১৬, ২০১৪)