হাজারও সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিট। দেশের প্রধান বার্ন ইউনিট হলেও এখানে নেই চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত পরিবেশ। অবকাঠামোগত সমস্যাসহ আছে ডাক্তার ও নার্স সঙ্কট। সাম্প্রতিক অতিরিক্ত দর্শনার্থীর চাপে রোগীদের সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়ছে। এ কারণেই বাড়ছে অগ্নিদগ্ধ রোগীর মৃত্যু ঝুঁকিও।

এত সব সঙ্কটের পরও সারাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় বাসে অগ্নিসংযোগ এবং পেট্রোলবোমায় দগ্ধ মানুষের স্থান হচ্ছে এই বার্ন ইউনিটেই। গত ২৬ অক্টোবর থেকে এ সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন অন্তত ২০০ জন। এ সময়ে এখানে ভর্তি হয়েছেন ৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে মারা গেছেন ২২ জন, ৪২ জন চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন এবং বর্তমানে ভর্তি আছেন আরও ৩৪ জন।

মেডিকেল সূত্র জানায়, বার্ন ইউনিটে স্বাভাবিকভাবে যে সব রোগী অগ্নিদগ্ধ হয়ে আসে তাদের চিকিৎসা দিতেই হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে চলমান সহিংসতায় রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা অনেকটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

সূত্র জানায়, গত বছর বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাসেবা নিয়েছে ৮ হাজার ১৯ জন। এর মধ্যে এখানে ভর্তি হয়েছে ৫ হাজার ৬৭৯ জন।

বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল বলেন, অগ্নিদগ্ধ রোগী সাধারণ রোগীর মতো নয়। অগ্নিদগ্ধ রোগীদের ইনজুরি একদিকে পেইনফুল, অন্যদিকে রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে। অগ্নিদগ্ধ রোগীদের বাঁচানোটাও একটা চ্যালেঞ্জ। মূলত বয়স এবং বার্নের হারের ওপর নির্ভর করে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। যেমন কারও বয়স যদি ২২ হয় এবং তার বার্ন যদি হয় ২২ ভাগ, তবে তার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ৪৪ ভাগ। আর যদি শ্বাসনালী পুড়ে যায় তবে এটা বেড়ে দিগুণ হবে অর্থাৎ ৮৮ ভাগ আশঙ্কা রোগী মারা যাবে।

তিনি আরও জানান, অগ্নিদগ্ধ রোগীদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা দিতে হয়। দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো কোনো পরিবেশ নেই এখানে। নেই নার্সিং করার মতো পর্যাপ্ত বেড ও নার্স।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি এখানে আসা রাজনৈতিক সহিংসতায় অগ্নিদগ্ধ অধিকাংশ রোগীই গুরুতর আহত। অনেক রোগীর শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। তাদের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে রাখতে হয়। এখানে একটি ইউনিট থাকলেও রোগীর অতিরিক্ত চাপের কারণে সব রোগীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। বর্তমানে দেশে প্রয়োজন ৪০০ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। কিন্তু এখন বাংলাদেশে আছে মাত্র ৩৬ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তাই রোগীদের একাধিকবার তারিখ দিয়েও করা যাচ্ছে না অপারেশন।

সূত্র জানায়, উন্নত দেশে বার্ন ইউনিটে ১-২ জন রোগীর জন্য ডাক্তার থাকে ২৫ থেকে ৩০ জন। আমাদের দেশের চিত্র উল্টো। এখানে ২৫-৩০ জন রোগীর জন্য ডাক্তার হচ্ছে ১-২ জন।

এ ছাড়া বার্ন ইউনিটে অতিরিক্ত দর্শনার্থীর কারণে সংক্রমণ রোধ করা যাচ্ছে না। দায়িত্বরত ডাক্তাররা জানান, সংক্রমণ রোধ করা না গেলে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। কেননা অগ্নিদগ্ধ রোগীদের স্কিন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্কিন অনেক স্পর্শকাতর এবং শরীর বাইরের রোগ জীবাণুকে প্রতিরোধ করতে পারে না।

বার্ন ইউনিটের উপদেষ্টা ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আমার ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় আমি কখনোই এত রোগী দেখিনি। এত রোগীর সেবা দেওয়ার মতো অবকাঠামোগত সাপোর্ট আমাদের নেই। তার পরও আমরা চেষ্টা করছি ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের বার্ন ইউনিটে নানা সমস্যা আছে। আছে নানা সীমাবদ্ধতাও। এর পরও আমরা কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।

(দ্য রিপোর্ট/এএইচএ/এইচএসএম/শাহ্/ এনআই/জানুয়ারি ১৬, ২০১৪)