কৃষককে আলো দেখিয়েছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ
মতিনুজ্জামান মিটু, দ্য রিপোর্ট : যাদুর ফাঁদ-ফেরোমন ফাঁদ। এই ফাঁদ কৃষকের মনে আশার আলো জ্বালিয়েছে।
ফাঁদ পেতে শিকার করা মানুষের এক আদিম প্রবৃত্তি। তাই বলে কেবলমাত্র ফাঁদ পেতে ক্ষতিকর পোকা দমনের কথা কি কেউ কখনো শুনেছে?
আসলে সময়ের বিবর্তনে বদলে যাচ্ছে মানুষ-বদলে যাচ্ছে সমাজ, সংসার আর মানুষের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রযুক্তিগত দিকটাও।
এইতো গত শতকের চল্লিশের দশকে যখন ড. মুলার কীটনাশক আবিষ্কার করলেন তখন একে এক ‘বিস্ময়কর আবিষ্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আর এখন মাত্র ৫০ বছর পর সেই আবিষ্কার মানুষের মাথার বোঝা হিসেবে পরিগণিত হতে চলেছে। আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে কিছু কিছু পোকা মাকড়ের সিনথেটিক কীটনাশকের প্রতি অঘোষিত বিদ্রোহ ঘোষণা।
এই পোকা মাকড়ের তালিকার প্রথম দিকে রয়েছে ফলছিদ্রকারী পোকার একটি বড় অংশ (fruit borerf), ফলের মাছি পোকা (fruit fly), সাদা মাছি পোকা (white fly) ইত্যাদি। বিদ্রোহী পোকা দমনে কৃষকরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে কীটনাশক।
এতে একদিকে মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। ঠিক এমনই এক সময়ে হতাশাগ্রস্ত কৃষকের সামনে আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে ‘যাদুর ফাঁদ’।
এই যাদুর ফাঁদটা আসলে কি? এটি একটি ফেরোমন ফাঁদ। পুরুষ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য যেমন স্ত্রীলোকেদের নানা কলাকৌশল থাকে, তেমনই প্রকৃতিতে পুরুষ পোকাকে কাছে টানার জন্য স্ত্রী পোকা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। যা সেক্স ফেরোমন নামে পরিচিত।
সেক্স ফেরোমনের গন্ধে পুরুষ পোকা পাগলের মত আকৃষ্ট হয়ে স্ত্রী পোকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিভিন্ন ফলছিদ্রকারী পোকা যেমন, বেগুনের ডগা ও ফলছিদ্রকারী পোকা বা ফলের মাছি পোকা। এদের স্ত্রী পোকারা যে ধরনের সেক্স ফেরোমন নিঃসৃত করে তা বর্তমানে আবিষ্কৃত হয়েছে। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হচ্ছে এই সেক্স ফেরোমন এবং যা বাণিজ্যিকভাবেও সহজলভ্য। ফলছিদ্রকারী পোকা যেমন বেগুনের ডগা ও ফলছিদ্রকারী পোকার ২-৩ মিলিগ্রাম পরিমাণ ফেরোমন, সূক্ষ্ম ছিদ্রসহ প্লাস্টিকের ছোট টিউবে ভরে অথবা ফলের মাছি পোকার ফেরোমন একখণ্ড তুলার টুকরায় ভিজিয়ে একটি প্লাস্টিক পাত্রের মুখ হতে ৩-৪ সেন্টিমিটার নিচেয় একটি সরু তার দিয়ে স্থাপন করা হয়ে থাকে।
সেক্স ফেরোমনের টিউবটি বা তুলা ঝুলিয়ে রেখে আকৃষ্ট পুরুষ পোকাকে আটকানো ও পরবর্তী সময়ে মেরে ফেলার জন্য এক ধরনের পোকা ধরার ফাঁদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উক্ত ফাঁদ ‘ফেরোমন ফাঁদ’ বা ‘গন্ধ ফাঁদ’ বা ‘যাদুর ফাঁদ’ নামে পরিচিত। কৃষকরা অনেক ক্ষেত্রে এটিকে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ নামেও বলতে শুরু করেছেন।
ফেরোমন টোপ বা একটি পোকা ধরা ফাঁদ ঝুলিয়ে রাখলে তা ৬-৭ সপ্তাহ পর্যন্ত পুরুষ মথকে আকৃষ্ট করতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে সংগ্রহ করে ধ্বংস করা হয়। তবে বাংলাদেশে সহজলভ্য দ্রব্যাদি দিয়ে তৈরি একধরনের পানি ফাঁদ অত্যন্ত সস্তা ও পোকা ধরার কাজে অত্যন্ত কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ওই ফাঁদ যে কেউ অতি সহজেই ঘরে বসেই তৈরি করতে সক্ষম।
এই ফাঁদ ব্যবহার করে বর্তমানের তুলনায় এক-চতুর্থাংশেরও কম খরচে প্রায় দ্বিগুণ ভাল বেগুনের ফলন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। কোনো ধরনের কীটনাশক (বিষ) প্রয়োগ করা হয় না বলে উদ্ভাবিত আইপিএম পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যগত সমস্যামুক্ত। আইপিএম বেগুন খেতেও যথেষ্ট স্বাদযুক্ত।
কীটনাশক প্রয়োগ করে যেখানে পোকা আক্রান্তের হার শতকরা ৪০-৫০ ভাগ, সেখানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে পোকা আক্রান্ত কুমড়া জাতীয় ফসলের সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগের নিচে নামিয়ে আনা এবং মাঠ খরচের চেয়ে প্রায় ১২-১৪ গুণ লাভ পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারী’র কীটতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান ড. সৈয়দ নুরুল আলম বলেন, ফেরোমন ফাঁদ যাদুর মত কাজ করছে। এটি মাঠ পর্যায়ে বিশেষ করে ফলছিদ্রকারীসহ বেশ কিছু পোকা দমনে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, ফেরোমন ফাঁদের পাশাপাশি জৈবিক বালাই যেমন-নিমজাতীয় বালাই নাশক এবং বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ধ্বংসকারী জীবাণু (মাইক্রোবিয়ালস) ব্যবহার করা যেতে পারে। সমন্বিত এই বালাই দমন ব্যবস্থাপনা জোরদার করা গেলে রাসায়নিক কীটনাশক বাদ দেওয়া সম্ভব হবে।
রবিবারে জয়দেবপুরে বারীর কীটতত্ত্ব বিভাগের ফেরোমন ফাঁদ ও মাইক্রোবিয়ালস পদ্ধতি ব্যবহারের সবজি ও সরিষার প্রদর্শনী খামার পরিদর্শনের সময়, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহামুদুন নবীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কীটতত্ত্ব বিভাগের এই কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ফেরোমন ফাঁদ বালাই দমনের পাশাপাশি মানুষও প্রকৃতির মাঝের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
কৃষক আইউব হোসেন বলেন, ফেরোমন ফাঁদ পদ্ধতি অভাবি কৃষকদের খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলে আনতে শুরু করেছে। রাসায়নিক কীটনাশকের স্থলে এই পদ্ধতি আরোপিত হওয়ায় বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত শাক-সবজি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বাজারে সমাদ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কীটতত্ত্ব বিভাগের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এই যাদুর ফাঁদ একদিকে যেমন হতাশাগ্রস্ত কৃষকদের মনে জাগিয়েছে নতুন স্বপ্ন, তেমনি কীটনাশক বাজারজাতকারীদের মাঝেও খুলে দিয়েছে মানুষকে সেবা করার নতুন দুয়ার। যাদুর ফাঁদ তাই সৃষ্টি করছে পোকা দমনের নতুন অধ্যায়-নতুন দ্বিগন্ত।
(দ্য রিপোর্ট/এম/এসবি/ এনআই/জানুয়ারি ১৬, ২০১৪)