কোন পথে জামায়াতে ইসলামীর আগামী দিনের রাজনীতি? প্রকাশ্যে নাকি আন্ডারগ্রাউন্ডে? জামায়াত নামেই নাকি নতুন কোনো দল গঠন বা জোটে একীভূত হয়ে রাজনীতির মাঠে সরব হচ্ছেন নেতারা। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নেতাকর্মীসহ সব মহলে।সংবিধানের সঙ্গে দলের গঠনতন্ত্রের কয়েকটি ধারা সাংঘর্ষিক থাকায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে দলটি। নিবন্ধন ফিরে পেতে আপিল বিভাগে জোরালোভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছেন জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা।
দলের নিবন্ধন শেষ পর্যন্ত ফিরে না পেলে রাজনৈতিক মাঠে টিকে থাকতে বিকল্প সব প্রস্তুতিই নিচ্ছেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল করলে ভিন্ন কোনো নামে রাজনীতি করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে নেতাদের। এ ক্ষেত্রে জামায়াত সমর্থিত কোনো ইসলামী-সমমনা দলের সঙ্গে নিজেদের একীভূত করারও চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৮ দলের অন্তর্ভুক্ত কমপক্ষে ৫টি দল রয়েছে বলে জামায়াত সূত্র জানিয়েছে। এসব দলের যেকোনো একটিতে বা আরো কয়েকটি দলের সমন্বয়ে একটি নতুন জোট বা দলে একীভূত হতে পারে জামায়াত।

জামায়াতের মাঠপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলে যেকোনো নাম নিয়ে দল বা জোট গঠন করা হতে পারে। এতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু নেতাকর্মীরা তো থাকছেনই।
জামায়াত সূত্র জানায়, রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে বিকল্প সব পথেই হাঁটছেন নেতারা। এ ক্ষেত্রে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড বা জাস্টিস পার্টি এবং তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টির ইতিহাসকে সামনে রেখে এগুচ্ছেন তারা।

সূত্র মতে, মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড বা ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি এবং তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীন একে পার্টির সঙ্গে জামায়াতের আদর্শিক মিল রয়েছে। প্রায় সমসাময়িক সময়ে এসব দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসব দল বেশ কয়েকবার নিষিদ্ধ হয়।এর পর নতুন নামে রাজনীতি করতে থাকে দলগুলো।সর্বশেষ তুরস্কের একে পার্টি তিন দফায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে। একইভাবে প্রচণ্ড গণবিক্ষোভের মাধ্যমে সেনাসমর্থিত হোসনি মোবারকের পতনের পর মিসরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় মোহাম্মদ মুরসির নেতৃত্বে ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি। যদিও এক বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ক্ষমতাচ্যুত হন মুরসি। এ দুটি দেশের সংশ্লিষ্ট দলগুলোর উত্থান-পতনের ঘটনা থেকে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটকাল অতিক্রম করতে জামায়াত নেতারা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, মহাজোট সরকার গঠনের এক বছরের মাথায় মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতারা বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন। ইতোমধ্যে দলের ৬ শীর্ষ নেতাকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেওয়া হয়েছে। ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার।রায় ঘোষণার অপেক্ষায় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলাটিরও। বাকিদেরও বিচার কাজ চলছে। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে দলের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পর মামলাটি এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

অন্যদিকে শীর্ষ নেতাদের মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী এখন কারাগারে। গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন বাকিরাও। কেন্দ্র থেকে মহানগর, জেলা-উপজেলা এমনকি অনেক ইউনিয়ন পর্যায়েও নেতৃত্ব দিচ্ছেন তৃতীয় সারির নেতারা। দলটির কেন্দ্রীয় আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ অধিকাংশ শীর্ষ নেতা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে রয়েছেন। এ অবস্থায় আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ অনেক পদই এখন ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে চলছে। একই অবস্থা অনেক মহানগর, জেলা ও উপজেলা কমিটির ক্ষেত্রেও। ভারপ্রাপ্তদের ভারে ক্রমেই সঙ্কটাপন্ন জামায়াত।

সাম্প্রতিক দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার পেছনেও জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। যদিও দলটি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এ ছাড়া রাজপথে সহিংস আন্দোলনের অভিযোগ তো আছেই। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক মাঠে কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামী। মগবাজারের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, পুরানা পল্টনের মহানগরী অফিসসহ অধিকাংশ মহানগর, জেলা-উপজেলা কার্যালয় এখন তালাবদ্ধ। প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। জামায়াত-শিবির দমনে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। স্বাধীনতার পর এমন সঙ্কট আর আসেনি দলটিতে, জানিয়েছেন একাধিক নেতা।

নানা দিক থেকে সঙ্কট ও কোণঠাসা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি আগামী দিনে কোন পথে পরিচালিত হচ্ছে-এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ খোদ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও। অস্তিত্ব সঙ্কটে থাকা এ দলটি এখন কোন পথে হাঁটবে, প্রকাশ্যে নাকি আন্ডারগ্রাউন্ডে? বৈধভাবে রাজনীতি করতে পারবে, নাকি পারবে না; কিংবা নতুন কোনো দল বা জোটে একীভূত হয়ে রাজনীতির মাঠে আসবে জামায়াত- এ প্রশ্ন এখন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে।

জামায়াত সূত্র জানায়, রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে সম্ভাব্য সব পথেই হাঁটছেন দলটির বর্তমান শীর্ষ নেতারা।মানবতাবিরোধী অপরাধে শীর্ষ নেতাদের মুক্তির জন্য চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখবে জামায়াত-শিবির। এ ক্ষেত্রে কিছু কৌশলী কর্মসূচিতে যাবে তারা। অন্যদিকে দলের নিবন্ধন ফিরে পেতে আপিল বিভাগে লড়বে আইনজীবী প্যানেল।

শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন ফিরে পাওয়া অনিশ্চিত এবং শীর্ষ নেতাদেরও মুক্তি মিলবে কিনা, এ ধরনের সংশয় নিয়েই এগোচ্ছেন দলটির নেতারা। সে ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখছেন তারা।

জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়, একটি মধ্যপন্থী ইসলামী দল হিসেবে আমেরিকা ও ইউরোপের মতো দেশগুলোর সঙ্গে জামায়াত সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে অনেক আগেই।এর ধারাবাহিকতায় পাশের দেশ ভারতের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় জামায়াত।এ ক্ষেত্রে জামায়াতের একটি কূটনৈতিক মিশন কাজ করছে বলে জানা গেছে।

সূত্রটি আরও জানায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করে। এ সময় তারা ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে তাদের কার্যক্রম চালায়। পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের সরকার বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করলে জামায়াতে ইসলামী আবারও রাজনীতি করার সুযোগ পায়। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে ভিন্ন কোনো নামে কার্যক্রম চালাবে দলটি।

বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে জামায়াত নেতাদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল হচ্ছে বলেও একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে একজন সিনিয়র আইনজীবী নেতার তত্ত্বাবধানে একটি প্রতিনিধি দল কাজ করছে।

বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে জামায়াত কী করছে? এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির নির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে জামায়াতের নিরপরাধ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে একটি সাজানো বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার বিচারের নামে তাদের হত্যা করতে চাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘জামায়াতকে দমন করতে গিয়ে কার্যত সরকারই নিজেদের অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট শক্তির পরিচয় দিয়েছে। সরকারের এই দমন-পীড়ন মোকাবেলা করতে গিয়ে কয়েক শ’ নেতাকর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেককে। এই জুলুম-নির্যাতনের কারণে সরকার গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।’

নতুন কোনো দল বা জোট গঠনের চিন্তা ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে হামিদ আযাদ বলেন, ‘জামায়াতের নিবন্ধন এখনও বাতিল হয়নি। আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে।আশা করছি আমরা ন্যায়বিচার পাব। যদি তা না হয় তাহলে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড বা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি কিংবা তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টিকে অনুসরণ করা হবে কিনা- জানতে চাইলে হামিদ আযাদ বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বাস্তবতা, সমস্যা-সম্ভাবনা এবং ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, বিশ্ব পরিস্থিতিসহ ইসলামের অনুসৃত নীতি ও কৌশলকে সামনে রেখেই প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দলীয় পলিসি নির্ধারণ করে কাজ করে থাকি।’

হামিদ আযাদ বলেন, ‘সরকারের জুলুম-নির্যাতনের ফলে জামায়াতের প্রতি জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন বেড়েছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, ইসলাম ও জনগণকে রক্ষায় চলমান আন্দোলন আরও বেগবান করে এ সরকারের পতন নিশ্চিত করা হবে।’

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এইচএসএম/শাহ/এনআই/ জানুয়ারি ১৬, ২০১৪)