দিরিপোর্ট২৪ প্রতিবেদক : ঝড়-বৃষ্টির রাতে একবার পপির জন্য মারা পড়তে যাচ্ছিলাম! সেই গল্প আগে বলি সবাইকে।

রাত সাড়ে এগারোটার মত বাজে। বাতাস দিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলামোটর মোড়ে তিন বন্ধু আমরা ভিজছি। যাবো মগবাজারে আরেক বন্ধুর বাসায়। রিক্সাও দেখছি না কোথাও। হঠাৎ একটা পাওয়া গেল। উঠলাম। আমরা ভেজাই ছিলাম। হুড তোলার দরকার নাই। আমাদের ঠোটে ঠাণ্ডা সিগারেট জ্বলে উঠল। রিকশা চলতে লাগলো। সব ঠিক।

৩ মিনিটও হয় নাই। এরমধ্যে হঠাৎঝড় শুরু হলো। কোত্থেকে একটা টিন সাই করে উড়ে গেল পাশ দিয়ে। সবাইকে বিহব্বল করে অদূরে ব্লাস্ট হলো একটা ট্রান্সফর্মার । আমাদের আর সাহসে কূলালো না। চালক মামা সাইড করলেন। কৈ দাঁড়াবো? বন্ধ একটা টং দোকান দেখলাম। ৪ জনেরই আশ্রয় এখন এর কোণায়। নাগরিক ঝড়ের তাণ্ডব দেখছি। একটু পর পর টিনের শব্দ শুনছি। কিন্তু দেখছি না এই মারণাস্ত্র কোথায়। তখন উপরে চোখ পড়ল। পাশের বিল্ডিংয়ের গায়ে সাঁটা বিলবোর্ড। তাতে ভোজ্য তেলের বোতল হাতে দাঁড়ানো পপি। বিড়বিড় করে আমাদের একজন দোয়া-দুরুদ আরম্ভ করলো. . .।

শেষ পর্যন্ত সে রাতে আমাদের কারো কিছু হয় নি। ইলেকট্রিক তার কারো গায়ে পড়েনি। বিলবোর্ডটিও মাথায় আছড়ে পড়েনি। সেই রাতে ওই পপি হতে পারত আমাদের প্রাণঘাতিনি!

সেই পপিকে সামনাসামনি পেলাম। প্রশ্ন, কেন বাংলা সিনেমার নায়িকারা এত মোটা? উত্তরার একটা শুটিং-বাড়িতে ও মেকাপ নিচ্ছিল।

পপি বলল, অনিয়মের জন্য। আমরা প্রফেশন্যাল না এজন্য। ফিট থাকার জন্য নিজেকে সময় দিতে হয়। আমরা সেটা পারি না। এজন্য আমরা আনফিট।

কিন্তু অনেক তাত্ত্বিক যে বলে আমাদের সিনেমা রিকশাওয়ালাদের জন্য বানানো হয়। আর রিকশাওয়ালাদের বউরা রুগ্ন এজন্য...। পপি এবার আয়না থেকে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালো। চোখে রাগ দেখলাম। মনে হচ্ছে প্রোডাকশন ডাকবে। ইন্টারভিউ আজকের মত খতম। কিন্তু না। এরকম মেয়ে ও না।

অভিমান শুনলাম গলায়। এটা কোনো কথা হলো? মনপুরার মিলি কি মোটা? আর ছবি তো সবার জন্য। একটা প্রফেশনের জন্য সিনেমা নাকি?

তাহলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সমস্যাটা কি?

পপি জানালো সমস্যা ৩টি।

১. অপেশাদারিত্ব। কেউ প্রফেশন্যাল না। আর্টিস্ট, ডিরেক্টর, টেকনিশিয়ান কেউই প্রফেশন্যাল না।

২. কারিগরি দুর্বলতা। মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি।

৩. গল্পের আকাল। অ্যাকশন, রোমান্স এই দুই ধরনের কাহিনীর প্রাধান্য।

পপির ধারণা এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা কারো একার চেষ্টায় সম্ভব না। সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পপি তখন বললো, সারাদিন ইন্ডিয়ান টিভি চ্যানেল দেখে বাংলাকে ভালোবাসি বললে হবে না। সিনেমা অনেক ভালো বিষয়। সমাজ বদলে দিতে পারে। এটা সবাইকে বুঝতে হবে।

আচ্ছা এটা কি সবাই বুঝে? আর আমাদের মিডিয়াই বা কী রকম? কী তাদের ভূমিকা? জানতে চাইলাম পপির কাছে।

ও বলল, আমাদের মিডিয়া খারাপ না। তবে ইন্ডাস্ট্রির জন্য দরকার আরো পজেটিভ প্রেস। লাক্স ফটোজেনিক হওয়া থেকে আমাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে প্রেস। তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু এটাও বলতে হবে আর সবখানের মত এখানেও দু’একজন খারাপ লোক আছে। এজন্য অবশ্য আমি প্রেসকে গালি দিতে চাই না। কারণ প্রেসকে গালি দিলে সেটা সোসাইটি বা দেশের জন্য ভালো হবে না।

দেশকে নিয়ে পপি কী ভাবে তা বোঝা গেল বাংলা সিনেমাকে নিয়ে ওর স্বপ্নের কথা শুনে।

“ বাংলা সিনেমাকে আমি অস্কারে দেখতে চাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একযোগে সিনেমা মুক্তি পাবে। ” কোথা থেকে এই স্বপ্ন দেখার সাহস আসে? এর উত্তরে ও যা বললো পপির মুখেই এমন কথা মানায়।

‘কেন এটা হবে না। ঐশ্বরিয়ার দুই চোখ আছে, আমার দুই চোখ নাই। স্পিলবার্গের দুই চোখ আছে , অমিতাভ রেজার দুই চোখ নাই। তাহলে কেন হবে না?’

সিনেমা নিয়ে আর্ট কমার্শিয়াল ইত্যাদি কূটতর্কের মধ্যে পপি নাই। ওর সাফ কথা, ‘সিনেমা তো সমাজের ঘটনা নিয়েই হয়। আর এটা একটা ইন্ডাস্ট্রি । যারা বাইরে কাজ করছেন সবারই এফডিসিতে এসে কাজ করা উচিত। গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নুরুল আলম আতিক, অনিমেষ আইচ, অমিতাভ রেজা সবারই কাজেরই ভক্ত তিনি। অফার পেলে এই গুণী নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করবেন বলে জানালেন পপি।

খুলনায় জন্ম, বড় হওয়া পপির। মুন্নুজান গার্লস হচ্ছে ওর প্রথম স্কুল। এরপর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হয়ে ঢাকায় আসা। এরপর থেকে চলচ্চিত্র পাঠশালার ছাত্রী সে। স্কুল পালিয়ে পপির দেখা প্রথম সিনেমা ‘বিক্ষোভ’। নায়ক সালমান শাহ’র কারণে তার সেই প্রথম হলে যাওয়া। রক্ষণশীল পরিবার তো আর এসব বোঝে না। দুদিন এসে গানের টিচার আসা বন্ধ হয় যেখানে। বিক্ষোভ দেখে বাসায় ফিরে বাবার হাতে মার খায় পপি।

সেই পপি পরে লাক্স ফটোজেনিক সুন্দরী হয়। বার্জার, এরোমেটিকের বিজ্ঞাপন দিয়ে আলোচনায় আসে। এরপর ফিল্মে ডাক। ৯৪ এ কুলি ছবি দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে যাত্রা শুরু। আর পেছনে তাকাতে হয়নি পপির।

৫ ফুট ৭ ইঞ্চির এই সুন্দরী ক্যারিয়ারের পুরো সময় ধরেই বাংলাদেশের বিনোদন সাম্রাজ্য এফডিসিকে মাতিয়েছেন। এখনও সে ধারায় আছেন। তারপরও কিছু আফসোস কি নেই? থাকে না মানুষের?

পপি তখন যা বললো শুনে ভাববেন ‘নারীবাদী’ কেউ। কিন্তু আবেগে কোনো ঘাটতি ছিল না ওর কথায়।

“ ফিল্মে মেয়েদের পেমেন্ট ভালো না। নায়িকাদের চেয়ে তিনগুণ বেশি টাকা পায় নায়করা। লুঙ্গি পরা অনেক প্রোডিউসারও আছে এখানে। এটা যে একটা শিল্প এরা তা বোঝে না। ”

পপির এমন মন খারাপ করা কথা দিয়ে পপি বৃত্তান্ত শেষ হতে পারে না। পপি শেষে বলল ও অন্য কোন খাতে টাকা ইনভেস্ট করবে না। ওর সাফ কথা , ফিল্ম প্রডিউস করব। সেটা ৬ মাসের ভেতরও হতে পারে। সাবাস! আমরা নিশ্চিত হলাম বাংলা ছবির দিন বদলে পপি আমাদের সাথী হচ্ছেন।

(দিরিপোর্ট২৪/এইচএস/এইচএসএম/অক্টোবর ৩০, ২০১৩)