আহমদুল হাসান আসিক, দ্য রিপোর্ট : চিকিৎসার দীর্ঘসূত্রতায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগী ও স্বজনদের জীবন। দিনের পর দিন হাসপাতালে থেকে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন রোগী ও সঙ্গে থাকা স্বজনরা। তারা জানেন না কবে এ দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পাবেন। এ কারণে অনেক রোগী হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না নিয়েই ফিরে যেতে চাইছেন।

সরেজমিনে বার্ন ইউনিট পরিদর্শনে রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার রোগীদের অভিজ্ঞতা দুর্বিষহ। সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ রাস্তায় বের হয়ে এখন তারা বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন। তারা জানেন না সুস্থ হবেন কিনা, অন্যদিকে তারা সুস্থ হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন কিনা এ নিয়েও আছেন শঙ্কায়।

শুধু রোগীই নয় স্বজনরাও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তারাও জানালেন হাসপাতালে থাকার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা। রোগীরা ঠিকমতো চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। দিনের পর দিন পরিবার পরিজন ছেড়ে অনেকেই এখানে পড়ে আছেন। এর মধ্যে অনেকেই হতদরিদ্র।

রোগীর স্বজনরা জানান, হাসপাতালে থাকার কারণে ছেলে-মেয়েরা কেমন আছেন তারা জানেন না। তারা কী খাচ্ছে না খাচ্ছে সে বিষয়েও কোনো খোঁজ জানেন না। আর এ সব কারণেই এখন তারা মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত। চলে যেতে চাইছেন হাসপাতাল থেকে।

এমনই একজন মো. রুবেল মিয়া। গত ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায় সিএনজি চালক মো. রুবেল মিয়া দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে দগ্ধ হন। রুবেল বলেন, আমি আর এখানে থাকতে চাই না। বাড়িতে গিয়ে মরলেও শান্তি পাব। আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে তারা কীভাবে থাকছে আমি জানি না। হাসপাতালে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে আছি, কিন্তু ডাক্তাররা কোনো কিছুই করতে পারল না।

রুবেলের স্ত্রী বলেন, আমি কী করব জানি না। আমার স্বামীকে ডাক্তাররা বার বার অপারেশন করার তারিখ দিয়েও অপারেশন করেননি। আমরা গরিব মানুষ, এখানে আর কতদিন এভাবে থাকব।

হবিগঞ্জের বানিয়াচং শরীফ খান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ জানুয়ারি ভোট কেন্দ্রে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোল বোমায় অগ্নিদগ্ধ হন মো. আব্দুল্লাহ। এখন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। শরীরের ৭ ভাগ পুড়লেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া নিয়ে সংশয় আছে। তিনি জানান, আনসারের সহযোগী হিসেবে ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এখনও জানেন না স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন কিনা। আবেগপ্রবণ হয়ে আব্দুল্লাহ বলেন, আমি লেখাপড়া করি নাই। আমার চাওয়া সরকার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে আমাকে সাহায্য করবে।

এদিকে গত ১২ নভেম্বর আবুল কালাম রাজধানীর পুরান ঢাকার রায়েরবাগ এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে আগুনে দগ্ধ হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। আমি জানি না কখন সুস্থ হবো। আমার জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

তিনি আরও বলেন, আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে মেয়ের চাকরির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পথেই এ ঘটনা ঘটে।

বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন মো. হারুন অর রশীদ ৯ নভেম্বর মাইক্রোবাস চালানোর সময় ময়মনসিংহ জেলা স্কুল সংলগ্ন সড়কে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় অগ্নিদগ্ধ হন। এর দুইদিন পরে সজীব ওয়াজেদ জয় হাসপাতালে দেখতে এসে সুচিকিৎসার আশ্বাসও দেন। কিন্তু সুচিকিৎসা পাননি বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, আমি এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব বলে মনে হয় না। আমার ছোট দুই সন্তানের কী হবে জানি না।

বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ সংকর পাল বলেন, বার্নের রোগীরা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না। তাদের কিছু মানসিক সমস্যা হয়। তাই যাদের কাউন্সেলিং প্রয়োজন তাদের কাউন্সেলিং করি। চিকিৎসা সেবার বিষয়টি হলো এখানে অনেক সমস্যা আছে, তারপরও আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের উপদেষ্টা ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, অগ্নিদগ্ধ রোগীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকাটাই স্বাভাবিক। এদের কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন। আমরা এখনও এটা চালু করিনি। তবে রোগীরা সুস্থ হলে আমরা এটা চালু করব।

চিকিৎসা নিয়ে অব্যবস্থাপনার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের আন্তরিকতা ও চেষ্টায় কোনো ত্রুটি নেই।

(দ্য রিপোর্ট/এএইচএ/এইচএসএম/এএল/ এনআই/ জানুয়ারি ১৭, ২০১৪)