ফুরফুরে মেজাজে নেতাকর্মীরা
আত্মতুষ্টিতে আওয়ামী লীগ
আমানউল্লাহ আমান ও বাহরাম খান, দ্য রিপোর্ট : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মুখে হাসি, কপালে ঘাম দেখা দেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। তবে নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীন এ দলটির নেতাকর্মীরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সংলাপে সাড়া না দিয়ে আন্দোলন করে দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধের মত ধারালো কর্মসূচি থেকে সরে আসাকে বিরোধী দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা হিসেবেই মনে করছেন ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকে সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করার চাপ থাকলেও খুব শীঘ্রই এই অবস্থা কেটে যাবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। তৎপরতার ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে অভিনন্দন জানিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
মহাজোট সরকারের প্রায় পুরো সময় জুড়েই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। যা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে আরও জোরদার হয়। শুরু হয় টানা অবরোধ কর্মসূচি। এ কর্মসূচিতে ১৮ দলের বাইরেও অনেক রাজনৈতিক দল নৈতিক সমর্থন দেয়।
অন্যদিকে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনায় আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও অনেক দেশই উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটাতে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ প্রতিনিধি জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশ সফর করেন। এই সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা দিলেও পরে তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, কিংবা আদৌ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা, এ নিয়ে আওয়ামী লীগকে দেশি-বিদেশি চাপে অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলতে দেখা যায়।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলে বিরোধী দলের আন্দোলনে দেখা দেয় টানটান উত্তেজনা। যে কোনো মূল্যে নির্বাচন প্রতিহতেরও ঘোষণা দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ। গ্রেফতার আতঙ্কে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা আত্মগোপনে থাকায় আন্দোলন অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে হামলা-ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির ডাক দেন ১৮ দলীয় জোট প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। এই সময় জোটের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, দেশের সর্বস্তরের মানুষ তাদের আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং ঢাকায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও ঘুম হারাম হয়ে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে ২৭ ডিসেম্বর থেকেই রাজধানী ঢাকাকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে দেখা যায়। ‘অঘোষিত কারফিউয়ের’ মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। খালেদা জিয়ার বাড়ির সামনেও গড়ে তোলা হয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়। ফলে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিলেও শেষমেশ আর নয়াপল্টনে যেতে পারেননি খালেদা জিয়া। তার এই ডাকে হালে পানি পায়নি বিরোধী দল। অন্যদিকে বিরোধী দলের ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ প্রতিহত করতে সমর্থ হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনের দিনে বিভিন্ন সংবাদ মাধমের খবরে দেখা যায়, ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার সংখ্যা একেবারেই কম। সহিংস ঘটনায় প্রাণ হারান অন্তত ২২ জন। ফলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল থেকে এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বলা হয়, নির্বাচন সংবিধান সম্মত হলেও জনগণের ম্যান্ডেট না থাকায় এই সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে খবর প্রকাশ করতে দেখা যায়।
তবে শপথ নেওয়ার পর প্রতিবেশি দেশ ভারত নতুন সরকারকে প্রথম স্বাগত জানায়। পরবর্তী সময়ে চীনও সরকারকে অভিনন্দন জানায়। এদিকে রাশিয়া বলেছে ‘প্রকৃত ভোটে’ নির্বাচিত সরকারকে স্বাগত জানানো হবে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, নির্বাচন নিয়ে দেশটি হতাশ হলেও বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাবে।
বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলের অনির্দিষ্টকালের অবরোধ প্রত্যাহার এবং কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ায় আগের তুলনায় এখন অনেকটাই ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
গণভবনে আয়োজিত নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেশ হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। তিনি ‘বিদেশি কোনো শক্তির কাছে মাথা নত করা হবে না’ বলেও দৃঢ়তা ব্যক্ত করেন।
অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিরোধী দলকে উদ্দেশ্ করে বলেছেন, ‘নৌবিহারের দিন শেষ। এখন নতুন করে রাজনীতি শুরু করতে হবে।’
আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দলীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে অনেকটাই ভাটা পড়ে। দলীয় কার্যক্রমেও অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তবে বিরোধী দলের ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি প্রতিহতে রাজধানীতে পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি মহানগরের নেতাকর্মীদের লাঠি ও পতাকা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান দলকে অনেকটাই চাঙ্গা করে তোলে। যা পূর্ণতা পায় নির্বাচন পরবর্তী সময়ে।
সরকার ও দলের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ভোটার উপস্থিতি কিছুটা কম থাকলেও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত লাগাতার সহিংসতা-নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করায় বিএনপি-জামায়াতের যারা সমর্থক তারা আসেনি। স্বাধীনতার পক্ষের সাধারণ মানুষ সকলেই এসেছিল ভোট দিতে। সে দিক থেকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই। এই বাস্তবতা অনুধাবন করেই দাতাসংস্থাগুলো এবং দেশগুলো রাষ্ট্রের উন্নয়নে সহযোগিতা করে তাদের সমর্থন দিয়েছে। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে পাশে থেকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির আর কিছু বলার নেই। তাদের এখন একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে হবে। আমাদের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ- গত এক-দেড় মাস বিএনপি-জামায়াত নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে তা কাটানো। সে জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর হস্তে দমনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের বিশ্বাস জনগণ এবং সরকার স্থিতিশীল ও ভাল অবস্থানে আছে।
এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, আওয়ামী লীগ কখনোই চাপের মুখে ছিল না। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সচেষ্ট ছিল। আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সে দায়িত্ব পালন করেছে এবং সফল হয়েছে। জনগণের সমর্থন নিয়ে আবার সরকার গঠন করেছে। কাজেই আওয়ামী লীগ চাপের মধ্যে ছিল এটা সত্য নয়। কেউ যদি আওয়ামী লীগকে চাপের মধ্যে ফেলতে চায় আওয়ামী লীগ সে চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না, আওয়ামী লীগের ইতিহাস এটাই বলে।
(দ্য রিপোর্ট/ এইউএ/ বিকে/ এইচএসএম/এনআই/জানুয়ারি ১৭, ২০১৪)