সেলিম আল দীনের নাটক : পাঠ ও দেখার যুথ-আনন্দ
মিরাজ মোহাইমেন
এক বিকেলের স্মৃতিদাগ : তখন বেঁচে ছিলেন কবি। কবি মানে আমাদের পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি আজীজুল হক। তার নামের বানান থেকে শুরু হল আলোচনা। হ্রস্ব-ইকার নয়, আজীজুলে দীর্ঘ ই-কারই থাকবে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এটি তাকে ঠিক করে দিয়েছেন। ঢাকার কোনো একটি পত্রিকা তার নাম হ্রস্ব-ইকার দিয়ে ছাপানোতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন তিনি। দৃষ্টিগ্রাহ্য বা দৃষ্টি-নন্দন বলে একটা বিষয় আছে। কানে শোনা, বইয়ে পড়া, আর চোখে দেখার পর আপনার অনুভূতি এক রকম না-ও হতে পারে। কবি আজীজুল হকের গোস্বা শেষ হলে এক মজার আক্ষেপ ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে। বললেন, “তোমরা ‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ পড়েছ?” সম্মতিসূচক জবাব দিলে কথা পাড়লেন। ‘যখন এই উপন্যাস আমি পড়ি- তখন দারুণভাবে আমি মোহিত হয়ে পড়েছিলাম। একটা ভার্স-জগ আমার সামনে ভেসে উঠেছিল। পাঠে আহা কী যে সে আনন্দ! এই আনন্দ মিইয়ে গেল একদিন আমার। উপন্যাসটি যখন সিনেমায় রূপ নিল, প্রেক্ষাগৃহে সেটা একদিন দেখতে গেলাম। দেখে মনটা ভেঙে গেল, তখন আমার চিন্তারাজ্যে দারুণ ব্যাঘাত ঘটল। দেখার চেয়ে পাঠের আনন্দই আমার সব থেকে বেশি নাড়া দিয়েছিল। আমার স্বপ্নের সেই জগ কোথায় যেন হারিয়ে গেল।'
যার সম্পর্কে এত কথা তিনি যে, চলচ্চিত্র বিষয়টি ভালো বুঝতেন না-ব্যাপারটি তা কখনও নয়। তিনি তার সমকালে শিল্পের একজন মহা সমঝদার ছিলেন। কিন্তু কথাটা হল গিয়ে পাঠ ও দেখার আনন্দ প্রসঙ্গে। সেটা বলতে গিয়েই এই স্মৃতিদাগটুকু উদ্ধার করা। একজন কবির অভিজ্ঞতার আলোটুকু ছড়িয়ে দিয়ে সেলিমের দিকে বাক ফিরালাম। নাটক আসলে একটা দৃশ্যকাব্য। তারপরও পাঠ ও দেখার যুথ-আনন্দ মেলে সেলিমের প্রতিটি নাটকে। পাঠকের যেমনি, একইভাবে দর্শকের মনোরাজ্যে রোপিত হয় মুগ্ধতার বীজ। এ কর্মযজ্ঞে এক অনবদ্য মুন্সিয়ানা পরিলক্ষিত হয় তার। মূলত সেলিমের লেখায় এক মহাকাব্যিক আবেদন থেকে যায় সকলের কাছে।
মহাকাব্যিক অভিযাত্রার নমুনা : তার প্রতিটি রচনাই ছড়িয়ে আছে হীরক-দ্যুতি। তার লেখা পড়তে পড়তে কী এক গভীর এক রাজ্যে হাতছানি দিয়ে নিয়ে যায় পাঠককে। একবারে একেকটা জীবন্ত রূপকথা। সেখান থেকে নিজেকে চ্যুত করাই খুবই কষ্টকর। এই রূপের লাবণ্যটা সত্যিই ব্যতিক্রমী। কথাপ্রিয় বাঙালির কথকতার বুননে আলাদা এক শৈলী তৈরি করেছেন তিনি। অন্তর্জালের কিছু রচয়িতার বক্তব্য উদ্ধার করে মিলিয়ে নেওয়া যাক আলোচনার যৌক্তিকতা।
প্রথম কথা হচ্ছে, সেলিম আল দীন বাংলা নাট্যজগতের এক অপার বিস্ময়। তিনি আসলে বিশ্বমানের নাট্যকার। বিশ্বনাট্যাঙ্গনে তার সাথে একজনের সাযুজ্য দেখি। তিনি মিশরের তাওফিক-আল্ হাকীমের। তবে তিনি আশ্রয় করেছেন মুসলিম ঐতিহ্য এ ওই অঞ্চলের প্রাচীন মিথকে। বিষয় বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যের অবশ্যই এটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। সেলিম ও হাকীম আমার তুলনার একটি পাঠ। তবে এ সুযোগ তেমন বর্তমান নিবন্ধে নাই। যাই হোক, মূল কথায় আমরা ফিরে আসি।
আদনান সৈয়দ লিখেছেন, প্রজ্ঞা, মেধা, মনন ও দক্ষতায় যে ক’জন নিরলস সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের সহজিয়া-লোকজ বাংলার উর্বর সংস্কৃতিকে বহুমাত্রায় বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছেন নাট্যকার সেলিম আল দীন ছিলেন তাদের ভেতর অন্যতম। বাংলার হাজার বছরের পুরোনো লোকজ উপাদানকে ব্যবহার করে জলজ এই ব-দ্বীপের পোড় খাওয়া, চির সংগ্রামী, সরল, স্বাধীনচেতা, আত্মনির্ভর, নির্ভীক, সাহসী মানুষদের জীবনকাব্যের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি অত্যন্ত সাবলীলভাবে সেলিম আল দীন তাঁর প্রতিটি নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। চরিত্রের এই যুক্তিসংগত গ্রহণযোগ্যতার কারণেই নাটক তখন শুধুই নিছক মঞ্চের ভাষা হয়ে থাকেনি, তাঁর নাটকের প্রতিটি সংলাপ জীবন্ত হয়ে মিশে গিয়েছিল আমাদের সাধারণ গার্হস্থ্য-জীবনের আনন্দ-বেদনার কাব্যে।
নাটক কী? এরিস্টোটল সেই অনেক আগেই বলেছিলেন, মানুষের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতি জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রতভাবে। আর সে কারণেই মানুষ প্রকৃতসৃষ্ট এক উন্নত মননপুষ্ট প্রাণী। এই প্রাণী জীবনের অপার চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা-ভালোবাসার অণু-পরমাণুর বাস্তব-অবাস্তব প্রতিফলন হচ্ছে নাটক। আর সে কারণেই জীবনের দিনলিপির আয়নায় এই নাটকের প্রতিটি চরিত্র আমাদের সামনে ধরা দেয় বহুরূপী হয়ে। আমরা যারা সমাজবদ্ধ জীব এবং আমাদের তৈরি এই সমাজকে আঁকড়ে ধরেই যখন আমাদের বাঁচা-মরার হিসেব-নিকেশ তখন আমরা জড়িয়ে পড়ি প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে এক অস্তিত্বের লড়াইয়ে। এই লড়াই করতে গিয়ে আমাদেরকে কখনও নায়ক, কখনও খলনায়ক, কখনও হয়ত নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। সেলিম আল দীন এমনি একজন সফল নায়কের নাম। তিনি আমাদের নাট্য অঙ্গনকে অলংকৃত করেছেন অত্যন্ত ভালোবাসা আর মর্যাদার সঙ্গে।
অপরদিকে, বজলুল করিম বাহার লিখেছেন, সেলিম আল দীন বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য বিরলপ্রজ নাম। সেলিম আল দীন শুধুমাত্র নাট্যকার নন, ছিলেন একজন নাট্যগবেষকও। বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে এতকাল ধরে প্রচলিত ধারা তৈরি হয়েছিল যে, আধুনিক যুগে ইউরোপীয় রেনেসাঁরই ফসল হচ্ছে থিয়েটার। সেলিম আল দীন এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার গবেষণাগ্রন্থ ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্য’ এর এক বিশাল পরিধিজুড়ে তিনি প্রাগাধুনিক বিভিন্ন লোকজ নাট্যরীতি সম্পর্কে অনুসন্ধানে তৎপর ছিলেন। ওই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, বাংলা থিয়েটার বা নাটকের সূত্রপাত ১৮ বা ১৯ শতকে ঘটেছিল, এই দাবি তিনি মানেন না। এবং হাজার বছরের প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ক্রম ধারায় নাট্যচর্চা বহমান ছিল। এই নাট্যরীতি ক্রম বিবর্তনের পথ ধরে এগিয়েছিল। এতে শুধু যে নাট্যরীতির পরিবর্তন ঘটেছিল তা নয়, বরং তা ভাষারও সংস্কার সাধন করেছিল।
তিনি ছিলেন আবহমান বাংলানাট্যের এক প্রবাদপ্রতিম দ্রষ্টা। তিনি শুধু নাট্য স্রষ্টাই নন, দ্রষ্টা। এ কারণে তিনি দ্রষ্টা যে, তিনি বাংলা হাজার বছরের সংস্কৃতির মাঝে ঘুমিয়ে থাকা নাট্যরীতির সম্বন্ধসমূহের আবিষ্কারক। এ ধরনের এক মৌলিক, স্থায়ী ও আপাত বিচ্ছিন্ন এক যোগসূত্রের মর্মস্থল তিনি আমাদের দেখানোর জন্য উদ্যমী ছিলেন। অয়ন গঙ্গোপাধ্যায় ‘সেলিম আল দীনের নাটক’ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, “বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও বিবর্তন সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেলিম ব্যবহার করেন ‘ভারতবর্ষ’ ও ’ইংরেজ শাসনামল’ এই দুই শব্দবন্ধ। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল এই দুই শব্দবন্ধ এক বিশেষ ঐতিহাসিক সত্যের দিকেই আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে চাইছে। অন্য একটি পৃথক জাতি-রাষ্ট্রের ইতিহাসের কথাই যেন বলতে চাইছে। বলতে চাইছে ’৪৭ নয় স্বাধীনতা, দেশবিভাগও; সংস্কৃতিও কী দেশবিভাগে বিভক্ত? সেলিম লিখছেন বাংলায়, তার লেখা নাটকগুলোতে বাংলা নাটকের প্রতি দায়বদ্ধতাই পরিলক্ষিত হয়।
তা হলে, একদিকে থাকছে বিভক্ত দু’টি আলাদা জাতি-রাষ্ট্রের তথাকথিত উত্তর-ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং অন্যদিকে থাকছে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রশ্ন, স্মৃতির প্রশ্ন, স্মৃতির ক্ষেত্রটিকে জাগিয়ে তোলার প্রশ্ন। ভুলে যাওয়া এবং এখনও অপসৃয়মাণ মান ওই সব লোকজ নাট্যরীতিগুলোকে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন নাট্যকার সেলিম আল দীন। বস্তুত বাঙালির হাজার বছরের নাট্য ইতিহাসের ছিন্নসূত্রকে তিনি তার সৃজনশীলতার আঁভগার্দের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করার নিরন্তর প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছিলেন।
১৯৭২ সাল। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে সেলিম আল দীন ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ নাটকটি লিখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল থেকে নাটকটি মঞ্চস্থ করা হয়। নাসির উদ্দীন ইউসুফ এই নাটকের নির্দেশক ছিলেন। অ্যাবসার্ড থিয়েটারের চিন্তা-চেতনা থেকেই এ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। বলাবাহুল্য, সেই যে শুরু তারপর সেলিম আল দীন ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে দু’জনের যুগলমিলনে এক অবিচ্ছেদ্য নাট্য নামের সূচনা হয়। সুদীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তারা দু’জন সৃষ্টিশীলতার এক অপরূপ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। একজন অবিরাম রচনা করেছেন, অপরজন বিরতিহীন নির্দেশনা দিয়েছেন।
১৯৭৩ সনে তাদেরই অভেদজ্ঞানের ক্যানভাসরূপে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। মঞ্চস্থ হয় জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, বিদায় মোনালিসা কিংবা সংবাদ কার্টুন। কিন্তু তখনও বাকি ছিল চেতনার পরিশোধন ও পরিশীলন। এ প্রসঙ্গে তাদের যৌথ বক্তব্য ছিল, “কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের যে শিল্পরস এবং বোধ আছে সেটা এই থিয়েটরের মধ্য দিয়ে পাচ্ছি না বলে আমাদের মনে হল।… শিল্পরস বলতে আসলে আমাদের বাঙালিদের। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের।’
ছিয়াত্তর সালে মঞ্চস্থ হল ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ এরপর ‘শকুন্তলা’। আগেরটি পাশ্চাত্য স্যাটায়ার ধর্মী নাট্যরীতি। ভুঁইফোঁড় বিত্তবান শহুরে মানুষের ফাঁপা ইনসিপিড জীবন বোধের ওপর তৈরি। যা ঠিক ‘প্রহসন’ও নয়। ‘শকুন্তলায়’ সেলিম মিথকে ভেঙ্গে এক অনাবরণ ন্যারেটিভ স্টাইল সঞ্চারিত করেছেন। বস্তুত সেলিম তার কাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এক ধরনের বাঁক নেয়। নাট্যকার সেলিম আল দীন অগ্নিপরীক্ষার এই পুলসেরাত পার হওয়ার পথে আর কখনও পিছনে ফিরে তাকাননি। সাহসী হয়েছিলেন দুর্মরভাবে আপন আত্মার অনারবরণ উন্মোচনে। এরপর বাঙালি শিল্প চেতনার রসে বশে নির্মাণ করলেন এক বিশালকায় নাট্য ক্যানভাস।
‘কীর্তনখোলা’ বহতা স্রোতে ঐতিহ্যসন্ধানী সূত্রগুলো হাতড়ে বেড়ালেন। এ নাটকেও লক্ষ্য করা যায় নারী নির্যাতনের এক ভিন্নধর্মী লক্ষণ। গ্রামীণ এক যাত্রাদলের কর্তা সুবল ঘোষ ইচ্ছে পোষণ করেন, তার দলের মেয়েরা এলাকার মাতব্বরদের রাত্রিকালীন বিনোদনে স্বেচ্ছায় অংশ নিক। যাত্রাদলের নিরাপত্তার স্বার্থে তার এই আপোসকামিতায় মেয়েরা প্রতিবাদী হয়। এভাবেই নাটকে একদিকে কীর্তনখোলার জনমানুষের জীবন, শিল্প, যৌনতা ও নৈতিকতাকে প্রকাশ করেন।
‘কীর্তনখোলা’ প্রসঙ্গে নাট্যকার তার এই শিল্প চেতনা নিয়ে বলেছেন, “… এতদিন আমি ভয়ে ভয়ে লিখতাম-মঞ্চের আয়তন, লজিস্টিক সাপোর্টের কথা ভেবে লিখতাম। কীর্তনখোলায় এসে আমি এটা একেবারে বাদ দিলাম। … কীর্তনখোলা আমাদের অভাবিত একটা দুয়ার খুলে দিয়েছিল।… কীর্তনখোলা কাব্যধর্মী এবং এটা কবিতার সমান পর্যায়ে এসেছে।” এ নাটকে চিরায়ত বাঙালি নারীর আর্কেটাইপিক্যাল বৈশিষ্ট্য তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। ডালিমন ও বনশ্রীবালা যেন চিরকালের বাঙালি নারীর শাশ্বত রূপ। সৎ, সামাজিক ও শৈল্পিক। একজন হিংস্র ও বৈরি। অন্যজন আত্মসমর্পিতা। একজন সম্প্রদায়ককে ভালোবেসে নিজেকে আত্মহত্যার মাধ্যমে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। অপরজন সম্প্রদায়কে ভালোবেসে তাদের সুরক্ষার জন্য আপোস করে। নিজের নারীসত্তাকে বিসর্জন দেয়। এ নাটকে চরিত্র অগণন। যেন শত শত মানুষ এক মহাকাব্যের পাদপীঠে এসে মিলিত হয়েছে। নাটকের পটভূমি এক মেলাকে কেন্দ্র করে। এই মেলা যেন গোটা বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে। এবং মানুষের এই মিলিত সমাবেশ উন্মোচিত করে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ মানুষের মধ্যকার নর ও নারীরসহ অবস্থানের ভেদজ্ঞান।
কীর্তনখোলার ফর্ম প্রসঙ্গে নাসির উদ্দীন ইউসুফ এভাবে মতামত ব্যক্ত করেন, “এর আগে নাটকে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখতে গিয়ে ঘর বানাত, রাস্তা বানাত যা ছবি এঁকে পেছনে রেখে দিত। সেট কর্মীরা ওগুলো দ্রুত সরিয়ে নিত। কিন্তু কীর্তনখোলা করতে গিয়ে আমি একটিই স্পেস তৈরি করলাম। সেই স্পেসটা আসলে পুরো বাংলাদেশ।” এ নাটকে সংলাপের বদলে বর্ণনার প্রতি জোর দেওয়া হয়েছিল। সংলাপগুলো ছিল ন্যারেটিভ। ন্যাট্যরীতি ছিল বর্ণনাধর্মী ও গীতিধর্মী। গান ও নাচের এক বিপুল আসর যেন দানা বেঁধে ওঠে। পালাগান, জারিগান ও সারিগানের এক লিরিক্যাল চেতনাপ্রবাহ, যা বাঙালি সংস্কৃতির মূল ধারায় সন্নিবেশীত ছিল তা বাঙময় হয়ে ওঠে।
‘কেরামতমঙ্গলও’ এক বিশাল ক্যানভাসে মঞ্চস্থ হওয়ার জন্য নির্মিত হয়। বহুরৈখিক ও বড় পরিসরের নাটক। আবহমান বাংলাদেশের ক্রমবিবর্তিত রাজনৈতিক ইতিহাস এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এর সামাজিক বন্ধন, দ্বন্দ্ব, অচলায়তন, সুখ, দুঃখ, নারীবিদ্বেষ সবকিছু এই নাটকের দ্বৈরথে এসে ভিড় করল। এখানেও অসংখ্য চরিত্র। নাট্যকার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কোনো সরলরেখায় নাটকটি এগোয়নি। সামনে যখন এগিয়েছে তখন এটা পাশেও কিন্তু স্ফীত হয়েছে।
কীর্তনখোলা এবং কেরামতমঙ্গল প্রযোজনার মধ্য দিয়ে আমরা একটা বিশাল ভূমি তৈরি করলাম। এর আগে মঞ্চে থিয়েটার হত প্রসেনিয়ামের মধ্যে। কিন্তু এই দুই নাটকে প্রসেনিয়াম ভেঙে মিলনায়তনের মধ্যে আমাদের অভিনয় হল। প্রসেনিয়ামও কিছু কিছু ব্যবহার করলাম। কিন্তু মূল অভিনয়টা মিলনায়তনের মধ্যে দর্শকের সামনে করা হল- এটা কোনো ফ্রেমের মধ্যে, চলচ্চিত্রের মতো একটা কোনো ম্যাচবক্সের মধ্যে কিছু লোক হাঁটাচলা করছে এটা কিন্তু তা না। একটা পরিষ্কার ঝকঝকে জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছু মানুষ কথা বলছে, দর্শক সেটা দেখছে।’ ন্যারেটিভ ড্রামার এই রীতিতেই সেলিম আল দীন এবার মেলালেন বাঙালির লোকায়ত যাপিত জীবনকে। সাপের কামড়ে সদ্যবিবাহিত এক বধূর করুণ মৃত্যুবিষয়ক সত্য কাহিনী অবলম্বনে বিনির্মাণ করলেন ‘প্রাচ্য’ নামক নাট্য। এক ভাগ্যাহত চাষীর স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের গল্প বিধৃত হল এ নাটকে। এই চাষী হাজার হাজার বছর আগেকার এক জীবনচরিত্র হতে পারে এ লোকবিশ্বাস যাদের আমরা প্রাচীন উপাখ্যান, মিথ বা পুরাণের সঙ্গে মিলও খুঁজে পাই। এই মিথোজীবিতা আমাদের স্মরণ করায় হাজার বছরের প্রাচীন লোককথা লালকমল-নীলকমল, কালকেতু-ফুল্লরা, নূহের প্লাবন, কারবালা, কঙ্কাবতী, চাঁদসদাগর ও মনসামঙ্গলের কথা। পুরাণকথার মধ্যে বিদ্যমান থাকে অপরিসীম সৃজনী সম্ভাবনা।
অশ্রুকুমার সিকদারের জবানীতে বলা যায়, “এ সব কাহিনীর অন্তর্গত অলৌকিক উপাদানগুলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের পরবর্তী প্রসারে বাতিল হয়ে যায় বটে। কিন্তু তার গূঢ় সাংকেতিক দ্যোতনা হারায় না। ফলে এইসব পুরাণের লোককথা শাশ্বতভাবে আধুনিক।”
নাট্যকার এই নাট্যপালার কাহিনী বাঁধেন কথা, পদ, শিকলী নাচাড়ি, বোলাম, পুনবোলাম, তত্ত্বকথা, দিশা, পুনঃকথা, অন্ত্যপর্ব ইত্যাকার সব পাঁচালী আদৃত তাৎপর্যময় বিন্যাসে। এ যেন সেই চম্পক নগরের সেই যাত্রাপালাই নতুনভাবে বিভা ছড়ায় যে মাপের কারণে ভাগ্যাহত চাষীর পুত্রবধূ সর্পাহত হয়, সেই সাপকে বাগে পেয়েও তারা ছেড়ে দেয়। দাদীর অশ্রাব্য গালিগালাজের মুখে সাপ তার ফণা নামায়। ‘এই হারামজাদা। ফণা নামা। একটাকে খাইছাস আর কী চাস? যা যা।- সয়ফর বুঝতে পারে সে এপারে সাপটি ওপারে। মাঝকানে সাদা শাড়ি পরা দাদী এক প্রশান্ত জলস্রোত। ওই পারে বহুদূরে সাপ দিগন্ত রেখার কাছে কালবৈশাখীর ক্রুদ্ধ রঙে রাঙা মেঘ। যে যার স্থানে থাকে।… তখন সাপটি ফণা নামায়। তারপর নোলকের নতুন কবরের উপর দিয়ে শ্লথ গতিতে বন্য অন্ধাকারে চলে যায়। সৌন্দর্য ভয় ও রহস্য সবার অন্তরে সম্ভ্রম জাগায়। হত্যা ভুলে যায় তারা।’ এ যেন জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় পরিবেশবান্ধব এক সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি।
হাসান আজিজুল হকের ‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পের সেই বাস্তুসাপের মন্ময় প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করায়। লিখলেন ‘হাতহদাই।’ আনার ভাণ্ডারী। সে সমুদ্র উপকূলের মানুষ। দুঃখ, কষ্ট, জন্ম-মৃত্যু এ সব উপজীব্য হয়ে ওঠে মানুষের অনন্তর লড়াইয়ের মাঝে। উপকূলের জনপদের বাসিন্দাদের জীবনসংগ্রাম। আনার ভাণ্ডারীর মতো লোকেরা মৃত্যুকে রুখে দেয়, প্রতিটি ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন করে জীবন লাভ করে। সমালোচকেরা এ নাটককে বলেছেন, ‘কার্নিভ্যাল অব এপিক।’
এ বিষয়ে সেলিম আল দীনের ভাষ্য, ‘… আমরা সরাসরি ওদের ওখানে গিয়েছি। ওদের সঙ্গে ওদের মিথ, ওদের স্টোরি নিয়ে কাজ করেছি। আবার ওদের এখনকার জীবনের বাস্তবতা নিয়ে যেমন আমরা এপিকে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, তেমনি ওদের মিথিক্যাল এপিকগুলোকে আমরা বাংলা ভাষায় নিয়ে এসেছি, রূপান্তরিত করে-ট্রান্সফর্ম করে নিয়ে এসেছি আমাদের ভাষায় এবং এটাকে আমরা নিউ এথনিক থিয়েটার নাম দিয়েছি। এটা ইংরেজি ভাষায় নেই-নিউ এথনিক থিয়েটার মানে নব্য নৃ-গোষ্ঠী নাট্য। সব মিলিয়ে টোটাল থিয়েটার এরেনাতে ঢাকা থিয়েটারের কন্ট্রিবিউশন। এতটা রিচ যে, আমি মনে করি না গত ২ শ’ বছরে আর কোনো দল এককভাবে বাংলা নাটকে এতটা কন্ট্রিবিউট করেছে।’
সেলিম আল দীন রচনা করেছেন যৈবতী কন্যার মন, নিমজ্জন, হরগজ, চাকা, ঊষা উৎসবসহ আরও বহু নাটক। আত্মদর্শন ও আত্মপরীক্ষাই যে একজন প্রকৃত নাট্যশিল্পীর অনির্বচনীয় কৃত্য- তা প্রমাণ করেছেন তিনি। মাত্র ঊনষাট বছরের জীবনকালে নাট্যচেতনায় এক মহত্তম স্থপতি হিসেবে নন্দিত হতে পেরেছেন। দস্তয়েভস্কির অন্য চরিত্র প্রিন্স মিশকিলের মতো হয়ত পারিপার্শ্বিকের কোনো পরিবর্তন তিনি ঘটাতে পারেননি, কিন্তু নিজের মধ্যে মানবতার দুঃসহ এক নিখিলবেদনাকে তিনি ধারণ করেছেন।
সেলিম আল দীন প্রেরণা পেয়েছেন হোমার, ফেরদৌসী, গ্যেটে আর রবীন্দ্রনাথের মতো কবিদের কাছ থেকে৷ তাঁদের কাছ থেকে বার বার ফিরে গেছেন একান্ত বাধ্যগত শিষ্যের মতো৷ আবার তাঁদের গুরু মেনে তাঁদের পেরিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা দিনরাত মনের ভেতরে লালন করতেন তিনি৷
কিন্তু তিনি এটাও জানতেন তাঁর সেই আশা কোনো দিন পূরণ হওয়ার নয়৷ শেষদিকে লেখা তাঁর দিনপঞ্জির অসংখ্য পাতায় এর প্রমাণ আছে৷ সেলিম আল দীন যে সব কাজ করেছেন সেগুলোর মূলে আছে পাশ্চাত্য শিল্পধারাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজস্ব শিল্প সৃষ্টি করে তা অনুশীলন করা৷ পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের লেখক, কবি, শিল্পী ও নাট্যকর্মীদের এই বোধে উজ্জীবিত করা যে আমাদের শিল্প ঐতিহ্য নিয়েই আমরা তৈরি করতে পারি আমাদের নিজস্ব শিল্পজগৎ৷ পরের অনুকরণ করে কখনও নিজস্বতা অর্জন করা যায় না৷ খুব জোরের সঙ্গে বার বার বলেছেন, ‘অন্যের বসন কখনও নিজের হয় না৷ হয় না সেটা নিজের ভূষণ৷’