রাজপথে নয় ভুঁইফোড়েই বেশি আগ্রহ বিএনপি নেতাদের
তারেক সালমান ও মাহমুদুল হাসান, দ্য রিপোর্ট : মাঠের আন্দোলন থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে সভা-সমিতি, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক ও আলোচনাই নিরাপদ মনে করছেন বিএনপি নেতারা। এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো। এই সব ভুঁইফোড় সংগঠনের ঘরোয়া সভা-সমাবেশে গরম বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চ কাঁপাতে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ বিএনপি নেতাকে।
এ ব্যপারে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমদ আযম খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আন্দোলনের বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে। বিএনপি কখনও সহিংস আন্দোলন করে না। বিএনপি উদারপন্থি দল হিসেবে কোনো সংঘাত চায় না। তাই আলোচনা, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছে তাদের দাবি তুলে ধরতে চায়।’
বিএনপি কর্মীরা বলছে, এ সব সভায় নেতারা ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত কাউকেই রাজপথে দেখা যায়নি। যে কারণে রাজধানীতে বিএনপির আন্দোলন জমে ওঠেনি। দলীয় অবস্থান ধরে রাখার জন্য ঘরোয়া পরিবেশে বক্তৃতাবাজি করাই তাদের অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে রাজপথে বিএনপির কঠোর কোনো কর্মসূচি নেই। এই সুযোগে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো। ফলে ঘরোয়া সভা-সমিতি আবার জমে উঠছে।
শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে স্বাধীনতা ফোরাম নামক এক সংগঠন সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়ার ৭৮তম জন্মদিন উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান, বিএনপির নির্বাহী সদস্য খালেদা ইয়াসমিন, এবিএম মোশারফ হোসেন বক্তব্য দেন। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আবু নাসের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ।
সরেজমিনে দেখা যায়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ভাসানী মিলনায়তন, ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে প্রায় দিনই কোনো না কোনো কর্মসূচি থাকে ওইসব সংগঠনের। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অথবা কোনো সিনিয়র নেতাকে প্রধান অতিথি করে আলোচনা সভা, সেমিনার, প্রতিবাদ সভা ও গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করাই তাদের মূল কর্মসূচি। এ সব সংগঠনের কোনো কোনো অনুষ্ঠানে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।
সংগঠনগুলো বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলের নামের প্রথম অংশ (জাতীয়তাবাদী), তৃণমূল বিএনপিসহ বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে। এ সব সংগঠনের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় নানান অভিযোগ উঠলে বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশে ওইসব সংগঠনের ব্যানারে কোনো আলোচনা সভায় না যাওয়ার জন্য দলের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
গ্রেফতার হওয়া দলের দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্মমহাসচিব রিজভী আহমেদ গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী বন্ধুদল, জাতীয়তাবাদী তরুণ দল, জিয়া ব্রিগেড, জিয়া মঞ্চ, দেশনেত্রী পরিষদ, তারেক রহমান পরিষদ, তারেক রহমান মুক্তি পরিষদসহ কতিপয় সংগঠন দেশব্যাপী বিএনপি, সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিএনপি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা সারাদেশের নেতাকর্মীদের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে এ সব ভুঁইফোড় সংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। দলের যে কোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের এ সব অননুমোদিত সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এ সব সংগঠনের সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা বিএনপি অস্বীকার করলেও অভিযোগ রয়েছে, দলের অনেক নেতাই এ সব সংগঠনের মূল পৃষ্ঠপোষক। যে কারণে এরা থেকে যাচ্ছে অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ ব্যাপারে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমদ আযম খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সব সংগঠনকে ভুঁফোড় বলা যাবে না। লক্ষ্য রাখতে হবে যারা কোনো অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত নয় তাদের সুযোগ দিতে হবে। কারণ সব কিছু রাজপথে সমাধান হয় না। কিছু বিষয় আলোচনার মাধ্যমে জনগণের সামানে তুলে ধরতে হয়।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ সব সংগঠন বিশেষ করে ‘তৃণমূল’ নামধারী সংগঠনের ব্যানারে কোনো কর্মসূচিতে না যাওয়ার জন্য দলের নেতাদের প্রতি ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘অনেকেই এই ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর সঙ্গে জড়িত। দলের পক্ষ থেকে যদি ব্যবস্থা নিতেই হয় তাহলে সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধেই আগে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, তাদের আসকারাতেই এ সব সংগঠন দিনের পর দিন তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।’
বিএনপির সহদফতর সম্পাদক আব্দুল লতিফ জনি দ্য রিপোর্টকে জানান, বিএনপি সঙ্গে মোট ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন রয়েছে। এর বাইরে দলে আর কোনো সংগঠন নেই।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, ছাত্রদল, যুবদল, সেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, শ্রমিক দল, কৃষক দল, তাঁতি দল, মৎসজীবী দল ও জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) হচ্ছে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। কিন্তু এর বাইরেও বেশ কয়েকটি সংগঠন আছে, এ সব সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা স্বীকার না করলেও সেগুলোর সভা-সমাবেশে সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
অনেক দলীয় সভা সমাবেশে সিনিয়র নেতাদের খুব একটা উপস্থিতি দেখা যায় না। দলের পক্ষে আয়োজিত সভায় যোগদানে অনীহা দেখা যায়। নিজেকে আলাদা করে দেখানোর সুযোগের জন্য ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোই বেশি পছন্দ তাদের।
১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এ আলোচনা সভায় সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। এ ছাড়া ১৬ ডিসেম্বর বিএনপির আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ।
জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে শনিবার দুপুরে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৭৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল আয়োজিত আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, ড. এম ওসমান ফারুক, শামছুজ্জামান দুদু, ডা. এম জেড এম জাহিদ হোসেন, শওকত মাহমুদ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদীন ফারুক প্রমুখ।
দলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দলের প্রতিষ্ঠার জন্মদিনের অনুষ্ঠান তারপরও নেতাদের উপস্থিতি নেই। কারণ এখানে এলে এককভাবে মিডিয়া কভারেজ পাওয়া যাবে না।’
এ ব্যাপারে বিএনপির প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদীন ফারুক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আস্তে আস্তে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছে। একটু সময় লাগবে। ঢাকা মহানগরীর নেতাকর্মীরাও উজ্জীবিত হচ্ছে।
ঘরোয়া পরিবেশ ও ভুঁইফোড় সংগঠনের ব্যাপারে বিএনপির নেতাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো এমন প্রসঙ্গে ফারুক বলেন, ‘কেউ যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে রাজনীতি করতে আসে, সংগঠন করে তাদের সুযোগ দেয়া উচিৎ। তবে যারা অপকর্ম করে তাদের সবাই ঘৃণা করে।’
(দ্য রিপোর্ট /টিএস-এমএইচ/এইচএসএম/এনআই/আরকে/জানুয়ারি ১৮, ২০১৪)