যৌন হয়রানিসহ কর্মক্ষেত্রে নানা নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক রফতানি ক্রমাগত বাড়ছে। সংসারের অভাব অনটন দূর করে ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে অল্প ও মধ্য বয়সী হাজার হাজার নারী পাড়ি দিচ্ছেন দূর দেশে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও জনশক্তি রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের চেয়ে নারী শ্রমিকের ওপর নির্যাতনের ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে।

নতুন বছরের চলতি মাসে জর্ডানে ১৫০ জন দক্ষ নারী শ্রমিক পাঠানোর অর্ডার এসেছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। গত ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) এর বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।

জনশক্তি রফতানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক বেগম শামছুন্নাহার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নারীদের বিদেশে যাওয়ার হার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কারণ আমরা তাদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছি। গৃহকর্মীর জন্য বিভিন্ন দেশের সময়োপযোগী ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদেরকে ট্রেনিং দিয়েই বিদেশে পাঠানো হচ্ছে।’

জনশক্তি রফতানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা যায়, গত বছর (২০১৩) বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক রফতানি হয়েছে ৫৬ হাজার ৪০০ জন। আগের বছর ২০১২ সালে ছিল ৩৭ হাজার ৩০৪ জন। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গত ২৩ বছরে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে মোট ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৬২ জন মহিলা শ্রমিক পাঠানো হয়েছে।

বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে ওমান, লেবানন, জর্ডান ও আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে ৫৬ হাজার ৪০০ নারী শ্রমিক পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১ হাজার ২৪৩ জন শ্রমিক গেছেন জর্ডানে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে আরব আমিরাতে ১৩ হাজার ৭১০ জন, সৌদি আরবে ১৬৭, ওমানে ৬ হাজার ৬৮ , কাতারে ২ হাজার ১০০, বাহরাইনে ১৪১, লেবাননে ১০ হাজার ৭৫০, হংকংয়ে ৩৯৩, মরিসাসে এক হাজার ৫৫৭ জন নারী বিদেশে গেছেন গত বছর। যাদের অধিকাংশই গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন।

বিএমইটির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গত ২৩ বছরে বিভিন্ন দেশে মোট নারী শ্রমিক রফতানি হয়েছে ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৬২ জন। ১৯৯১ সালে ২ হাজার ১৮৯ জন, ১৯৯২ সালে এক হাজার ৯০৭ জন, ১৯৯৩ সালে এক হাজার ৭৯৩ জন, ১৯৯৪ সালে এক হাজার ৯৯৫ জন, ১৯৯৫ সালে এক হাজার ৬১২ জন, ১৯৯৬ সালে এক হাজার ৯৯৪ জন, ১৯৯৭ সালে এক হাজার ৭৬২ জন, ১৯৯৮ সালে ৯৩৯ জন, ১৯৯৯ সালে ৩৬৬ জন, ২০০০ সালে ৪৫৪ জন, ২০০১ সালে ৬৫৯ জন, ২০০২ সালে এক হাজার ২১৬ জন, ২০০৩ সালে দুই হাজার ৩৫৩ জন, ২০০৪ সালে ১১ হাজার ২৫৯ জন, ২০০৫ সালে ১৩ হাজার ৫৭০ জন, ২০০৬ সালে ১৮ হাজার ৪৫ জন, ২০০৭ সালে ১৯ হাজার ৯৪ জন, ২০০৮ সালে ২০ হাজার ৮৪২ জন, ২০০৯ সালে ২২ হাজার ২২৪ জন, ২০১০ সালে ২৭ হাজার ৭০৬ জন, ২০১১ সালে ৩০ হাজার ৫৭৯ জন, ২০১২ সালে ৩৭ হাজার ৩০৪ জন এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে ৫৬ হাজার চার শ’ জন নারী শ্রমিক বিদেশে পাঠানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে যে সব নারী শ্রমিক ভাগ্য বদলের জন্য বিদেশে গেছে তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের দুর্দশার শিকার হচ্ছেন তারা৷ শারীরিক নির্যাতন, হুমকি-হয়রানি ও বেতন বৈষম্য তো আছেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলোতে এই সমস্যা বেশি৷ এ সব দেশের মধ্যে লেবানন, জর্ডান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশী অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শতকরা ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু শ্রম আইনের নানা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত, প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত নারী শ্রমিকরা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) তথ্য মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী বাংলাদেশী নারী শ্রমিকদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৩৫ ভাগ নারীই সহিংসতা, নির্যাতনসহ নানা সমস্যার শিকার হচ্ছেন৷ নির্যাতনের পর তারা চিকিৎসা সেবাও পাচ্ছেন না৷ তা ছাড়া দালালদের মাধ্যমে বেশি টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে শ্রমজীবী নারীরা বেতন কম পাচ্ছেন৷

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী জানান, গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়ে বিদেশে যাওয়া অনেক নারী শ্রমিক যৌন ও শারীরিক নির্যাতন, চুক্তিভিত্তিক বেতন না পাওয়া ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হন৷ লেবানন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহপরিচারিকার কাজে মেয়েদের পাঠানোর জন্য দালালদের একটি চক্র তৈরি হয়েছে৷ তারা এটিকে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে দেখছে৷ তারা গ্রামের লেখাপড়া না জানা, অল্প বয়স্ক মেয়েদের বেশি বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ পাঠায়৷ অথচ কোথায় কোন কোম্পানিতে বা গৃহকর্তার অধীনে সে কাজ করছে তা আগে থেকে সে জানতেও পারে না৷ কর্মক্ষেত্রে এ সব নারী প্রায় ৮০ শতাংশ যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷

এ ব্যাপারে বিএমইটির মহাপরিচালক বেগম শামছুন্নাহার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা খুবই কম। মহিলা শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা অনেকটা কমে এসেছে। দু-একটা ঘটনা ঘটলে সবাই হৈ চৈ শুরু করে। কোথাও এ ধরনের সমস্যার কথা শুনলেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা এর সমাধানের চেষ্টা করি।’

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এইচএসএম/এএল/ এনআই/জানুয়ারি ১৯, ২০১৪)