স্থবির ব্যাংক কার্যক্রমে পরাহত প্রবাসের হাতছানি
স্থবির হয়ে পড়েছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কার্যক্রম। অর্থের অভাব, অনভিজ্ঞ লোকবল, প্রচারণায় ঘাটতি এবং স্বল্প সময়ে অপরিকল্পিতভাবে ২৭টি শাখা চালু করায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে বিশেষায়িত এ ব্যাংক।
জানা গেছে, শুরুর দিকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক বেশ সাড়া ফেললেও পরবর্তী সময়ে নানা কারণে এর কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। চাহিদামাফিক গ্রাহকদের ঋণ দিতে না পারা, প্রচারণার অভাব সত্ত্বেও স্বল্প সময়ে ২৭টি শাখা চালু করা এবং ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে অনভিজ্ঞ লোকবলের সমাগম হওয়ায় মাত্র তিন বছরের মাথায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে এ ব্যাংকের কার্যক্রমে।
সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন বছরে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের সংখ্যা মাত্র ২০১৬টি। যার মধ্যে পুনর্বাসন ঋণ রয়েছে ৪৭টি। আলোচ্য সময়ে ব্যাংক মাত্র ৩০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। অথচ এরই মধ্যে ২৭টি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনেও এ বিষয়টিকে নজিরবিহীন ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ রয়েছে, দেশ ভেদে ৯০ হাজার থেকে থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। অভিবাসন ঋণ, প্রকল্প ঋণ, পুনর্বাসন ঋণ, সঞ্চয়ী হিসাব, ঋণ আচ্ছাদন ঝুঁকি বীমা, ডিপিএস, দ্বিগুণ মেয়াদী আমানত ও স্থায়ী মেয়াদী আমানত এই রকম ৮টি সেবার মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করলেও ঋণ বিতরণ ছাড়া অন্য সেবাগুলোতে গ্রাহক আকর্ষণ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এর কারণ হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম চালাতে না পারাকে দায়ী করছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন, ‘হয়ত এ টাকা দিয়ে প্রবাসীদের তেমন কোনো উপকার হচ্ছে না। তবে এ কথা সত্য, আমরা তাদের সতর্ক করতে পারছি যে, এই টাকায় বিদেশ যাওয়া যায়। এতে করে তাদের সচেতনতা বাড়ছে।’
এ বিষয়ে ব্যাংকের প্রধান শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক মাসুদুর রহমান বলেন, গ্রাহক টানতে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। আশা করছি খুব শিগগিরই আমরা গ্রাহক বাড়াতে পারব।
এদিকে ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উন্নতি হবে কীভাবে! এর পরিচালনা পর্ষদের ১০ জনের মধ্যে সাতজনের ব্যাংকিং খাতে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অথচ তারা পরিচালক হয়ে বসে আছেন। আর ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নেই এমন অনেক ব্যক্তিকে বসানো হয়েছে বিভিন্ন পদে।
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের প্রধান শাখায় দেখা গেছে, ঢাকার কেরাণীগঞ্জের আসাদুল হক ও ময়মনসিংহের লোকমান হোসেন চাহিদা মাফিক ঋণের জন্য আবেদন করেও পাননি।
জানতে চাইলে আসাদুল হক বলেন, বিদেশ যাওয়ার জন্য ঋণ চাইতে এসেছি। এরা সৌদি আরব যাওয়ার জন্য আমাকে মাত্র ৯০ হাজার টাকা দিতে চায়। অথচ আমার খরচ পড়বে ৫ লাখ টাকা।
লোকমান হোসেন বলেন, আমি যাব রাশিয়ায়, আমাকে মাত্র ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বলছে তারা। এই টাকায় রাশিয়া যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তবে পুনর্বাসন ঋণের সুবিধাভোগী নোয়াখালীর আক্কাছ আলী বলেন, আমি এদের ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছি। আমি আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে জেনেছি। তবে ব্যাংকের প্রচারণা আরো বেশি হলে বেশি সংখ্যক লোক উপকার পেত বলে জানান তিনি।
সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সি এম কায়েস সামি বলেন, সরকার একটি মহৎ উদ্যোগ নিয়ে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা আশা করছি প্রান্তিক পর্যায়ে গ্রাহকদের কাছে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পৌঁছাতে পারব।
তাহলে তিন বছরের মাথায় ঋণ বিতরণে স্থবিরতা কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে কায়েস সামি বলেন, সরকার এটিকে বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে চালু করেছে। কিন্তু যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে তাতে সবাইকে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। এই কারণে আমি মনে করি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমাদের কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেওয়া জরুরি। এতে করে আমরা স্বাবলম্বী হব এবং আমাদের কার্যক্রম আরো বিস্তৃত হবে।
প্রসঙ্গত, কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে বাংলাদেশী বেকার যুবকদের সহায়তা, প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের পর কর্মসংস্থানে সহায়তা, দেশে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত ও সাশ্রয়ী পন্থায় রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আইন, ২০১০ এর আওতায় ২০১১ সালে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সরকার।
বিশেষায়িত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি এবং পরিশোধিত মূলধন ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচ শতাংশের যোগান দিয়েছে সরকার এবং বাকি অংশ ওয়েজ আর্নার কল্যাণ তহবিল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
(দ্য রিপোর্ট/এএইচ/ডব্লিউএন/এইচএসএম/ এনআই/জানুয়ারি ১৯, ২০১৪)