রাজনীতির নতুন মাত্রা : সংঘর্ষের গ্রামায়ণ
২৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলা ৬০ ঘণ্টার হরতালে ২০জনের মত মানুষ মারা গেছেন। জখম হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। গাড়ি, ফেরি ও ট্রেন পোড়ানো, দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাটে সারা দেশে ঘটেছে কোটি-কোটি টাকার সম্পদ হানি। হরতালে দেশের সার্বিক অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিসংখ্যান হয়তো মিলবে না!
বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে হরতাল কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আগে যা ছিল মূলত বড় বড় শহর কেন্দ্রিক। হরতালে খুন খারাবিও বেড়েছে গ্রাম পর্যায়ে। এই ৬০ ঘণ্টার হরতালে রাজনীতির কেন্দ্র রাজধানী ঢাকায় একজনও মারা যায়নি। চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, গাজীপুর, রংপুরের মতো সিটি কর্পারেশনগুলোতেও কেউ মারা যায়নি। এটাকে হরতাল বা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন বলেও মনে করা যেতে পারে।
এবারের হরতালে আর একটি বিষয় বেশ দৃশ্যমান-তা হলো পুলিশের সঙ্গে হরতালকারীদের সংঘর্ষের চেয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াতের সংঘর্ষ ও হানাহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে প্রতিপক্ষের বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর এমনকি উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে প্রচুর। রাজতীতির এই গুণগত (নেতিবাচক অর্থে) পরিবর্তন কেন তা বিশ্লেষণ জরুরি। বলা যায়, গ্রাম বা ছোট শহর কেন্দ্রিক সহিংসতার মধ্যে রাজনৈতিক, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ব্যক্তিগত আক্রোশ ও অভিলাষ বিশেষ গুরুত্ব পেযেছে। প্রসঙ্গটি এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে এ ধরনের সংঘাত শুরু করা যায়, কিন্তু শেষ করা যায় না। এটি চলে বংশ পরম্পরাই, দীর্ঘ সময় ধরে। সময় সুযোগ মতো চলতে থাকে পাল্টা-পাল্টি প্রতিহিংসা, না থাকে আদর্শ, না থাকে দলীয় শৃঙ্খলা। আর যে জিনিসটি প্রবল হয়ে উঠে তা হলো রাজনীতির চেয়ে পেশিশক্তির প্রাধান্য। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দখল করে নেয় পেশিশক্তিতে বলিয়ান অরাজনৈতিক শক্তি। এটা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের চেয়ে নিজ দলকেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। শেষ পর্যন্ত যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য পেশিশক্তির আমদানি ঘটানো হয় সেই রাজনৈতিক আদর্শই জনগণের কাছে পরিত্যাক্ত হয়। কর্তৃত্বও শেষ পর্যন্ত ধসে পড়ে। এবারের হরতালসহ সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক লড়াই আমাদের সমাজকে তেমনি একটি গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে ক্রমেই আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। দুটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আদর্শবাদী নেতারা বিষয়টি অনুধাবন না করলে আগামীতে পরিস্থিতির দ্রুতই অবনতি ঘটবে। ক্ষমতায় থাকা বা অধিষ্ঠিত হওয়ার চেয়ে এ বিষয়টি কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।