শামীম রিজভী, দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের প্রথম শহীদ ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী ২০ জানুয়ারি, শহীদ আসাদ দিবস। এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৬৯ সালের এ দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার তথা পাকিস্তানি আমলা-সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ঘটেছিল।

এদিনে শহীদ আসাদের চেতনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানবসত্তা। অধিকার বঞ্চিত মানুষ নতুন করে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।

শহীদ আসাদ ১৯৪২ সালের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুর থানার ধুনুয়া গ্রামে। বাবার নাম আলহাজ মোহাম্মদ আবু তাহের। আসাদ ১৯৬০ সালে মেট্রিক এবং ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

১৯৬২ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব বাঙালি দালালদের সঙ্গে নিয়ে বাঙালি জাতির মগজে চাপাতে চেয়েছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির পরিবর্তে পাক সংস্কৃতি। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব জনরোষকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করার জন্য পাক-ভারত যুদ্ধ লাগিয়ে দেন কাশ্মীরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যাপারটি লক্ষ্য করে ১৯৬৬ সালে লাহোরে ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন। পূর্ববাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে ৬ দফা হয়ে দাঁড়ায় বাঙালির মুক্তি সনদ। ১৯৬৭ সালে ৬ দফার জনপ্রিয়তা ধ্বংস করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করা হয়। মামলাটির নামই ছিল স্টেট বনাম শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐতিহাসিক ১১ দফাও ৬ দফার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১১ দফাকে সমর্থন করেন মওলানা ভাসানী, পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। এটা জনতার দাবিতে পরিণত হয়। এ সময় চলছিল ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের সামরিক আদালতে আগরতলা মামলার আসামিদের বিচারের প্রহসন। তাদের হত্যার নীলনকশা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু গোপনে মওলানা ভাসানীকে একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে একটি চিরকুট পাঠিয়ে আন্দোলনের হাল ধরার অনুরোধ করেন। পরদিনই মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা দেন।

আন্দোলন দমন করার জন্য আইয়ুব সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন দুঃসাহসী ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ সভা ও শোভাযাত্রা বের করেছিল। কয়েক হাজার পুলিশ-ইপিআর ওই ছাত্র মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই সাহসী তরুণের প্রত্যেকেই আহত হয়ে বন্দি হয়েছিলেন।

২০ জানুয়ারি ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অকুতোভয়ে পুলিশ-ইপিআরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। সেদিন জনতার মারমুখী প্রতিবাদের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল পুলিশ-ইপিআর। অকেজো হয়ে গিয়েছিল কাঁদানে গ্যাস। সব বাধা অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে বেরিয়ে বিরাট শোভাযাত্রা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে যায়। মেডিকেল কলেজের সামনে সেই শোভাযাত্রায় পাকিস্তান পুলিশ এবং ইপিআর বাহিনীর বুলেটের আঘাতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন মাস্টার্সের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ। তার মৃত্যুতে ’৬৯-এর গণআন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। জনতা আসাদের লাশ ছিনিয়ে মুখোমুখি লড়েছিল সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আসাদের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে।

২৪ জানুয়ারি প্রতিবাদ দিবস ছিল কিন্তু দিবসটি রূপান্তরিত হয় গণঅভ্যুত্থান দিবসে। দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হয় সেদিন। জনতার ওপর বার বার গুলিবর্ষণে ছাত্রসহ ৬ জন নিহত ও বহু আহত হয়েছিল। সেক্রেটারিয়েটের গেটে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন শেখ রুস্তম আলী, মকবুল আর নবকুমার স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান। বিক্ষুব্ধ জনতা শহীদ মতিউরের লাশ নিয়ে ঢাকার সর্ববৃহৎ শোভাযাত্রা বের করেছিল। আর সেদিনই জনতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিস। আরও পুড়েছিল আগরতলা মামলার প্রধান বিচারক এস রহমানের বাসভবন, সরকারি অতিথিশালা, নবাব আসকারির বাড়ি, রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধকারী খাজা শাহাবুদ্দীনের আবাস।

গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পেছনে আসাদ ও মতিউরের আত্মদান মূল ভূমিকা পালন করেছে। তারা আমাদের জাতীয় বীর। তারা বাঙালির হৃদয়ে স্থান পেয়েছেন। কবি শামসুর রহমান তার কবিতায় আসাদ ও মতিউরকে অমর করে রেখেছেন।

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/জেএম/জানুয়ারি ২০, ২০১৪)