প্রকল্প বাস্তবায়নে এনজিওর দিকে ঝুঁকছে দাতারা
প্রকল্প বাস্তবায়নে দাতাদের এনজিও প্রীতি বাড়ছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি ইদানীং এনজিওর দিকে ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দাতা সংস্থাকে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সর্বশেষ প্রকাশিত এক সমীক্ষার সুপারিশেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
সমীক্ষা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিছু উন্নয়নসহযোগী প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব এবং জটিলতার যুক্তি দেখিয়ে সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাদ দিয়ে তাদের নিজস্ব এজেন্ট এবং এনজিওর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী। ইতোমধ্যেই এমন কিছু নিদর্শনও দেখা গেছে। এ অবস্থায় সুপারিশ করা হয়েছে যে, বিষয়টি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অতিসত্বর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া উন্নয়ন সহযোগিতা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর অনুমোদন ত্বরান্বিত করা উচিত।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, এনজিও বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে। এটি স্বীকার করতেই হবে। তবে অনেক সমস্যাও রয়েছে।
ড. শামসুল আলম বলেন, জাতীয় সংকটকালীন অনেক এনজিও জাতীয় স্বার্থেও বিষয়টি ভুলে গিয়ে দাতাদের সঙ্গে সুর মেলায়। এ ক্ষেত্রে তারা দাতাদের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করে। তারা চেষ্টা করে কীভাবে দাতাদের খুশি করা যায়। এ কারণে দাতারাও চেষ্টা করে এনজিওদের খুশি করতে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। কেননা, সরকারকে পাশ কাটিয়ে এনজিওর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রবণতাকে সমর্থন করা যায় না। এতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
জানা গেছে, ২০১২ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দেওয়া অনুদানের প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। এ টাকা এনজিওদের পেটে যাওয়ার আশঙ্কা করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। কেননা, আর্থিক শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এনজিওর মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তা ছাড়া অনুমোদনের আগেই দাতা সংস্থার খেয়াল খুশি মতো নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল বাস্তবায়নকারী হিসেবে একটি এনজিওকে। এনজিওটি আবার নিয়োগ করার কথা আরও ৭টি এনজিওকে। এই পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) সভায় এটি অনুমোদন না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়ার সুপারিশের জন্য বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা ডাকা হলেও সভায় উপস্থিত অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতার কারণে শেষ পর্যন্ত তা স্থগিত রাখা হয়েছিল।
স্থগিত রাখার কারণ হিসেবে জানা গেছে, অনুমোদনের আগেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের পছন্দ মতো এনজিও নিয়োগ দেওয়ায় অনুদানের এই টাকা নয়-ছয়ের শঙ্কা করেছিল পরিকল্পনা কমিশন।
এই প্রকল্পের বিষয়ে এডিবির বাংলাদেশ মিশনের উর্ধতন কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সূত্র জানায়, ইনস্টিটিউশনাল সাপোর্ট ফর মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স রেমিটেন্স শীর্ষক কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) মোট ১৪ কোটি ৮৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকা অনুদান অনুমোদন করে। এ বিষয়ে ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি সরকারের সঙ্গে একটি অনুদান চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়ে।
দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশন মতামত দেয় যে, প্রকল্পটি এডিবির অনুদানে জানুয়ারি ২০১২ হতে ডিসেম্বর ২০১৪ মেয়াদে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিপিপির (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) ৫ নং অনুচ্ছেদে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেখানো হলেও টিপিপির(টেকনিক্যাল প্রজেক্ট প্রপোজাল) ২১ দশমিক ৩ নং অনুচ্ছেদে দেখা যায় বাস্তবায়নকারীর সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব অল্টারনেটিভ ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিটিউশন বাংলাদেশ (ইনাফি) নামে একটি এনজিও। টিপিপির (টেকনিক্যাল প্রজেক্ট প্রপোজাল) ৩০ পৃষ্ঠায় দেখা যায়, ইনাফি এ প্রকল্পের কার্যপত্রের ১০ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত কার্যক্রমসমূহ পরিচালনা করবে। প্রকৃতপক্ষে, উল্লিখিত (কার্যপত্রের ১০নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত) কাজগুলোই এ প্রকল্পের মূল কাজ, যা ইনাফি নামক এনজিওটি সম্পাদন করবে। সরকারের প্রচলিত নিয়মে শতভাগ অর্থায়নে এনজিওকে সহায়তা প্রদান কার্যক্রম নিয়ে একটি প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা আদৌ যৌক্তিক হবে না। কার্যক্রমগুলো এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
পরিকল্পনা কমিশনের অপর মতামতে বলা হয়েছিল, টিপিপির ১৯ নং পৃষ্ঠায় দেখা যায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৬ কোটি ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকায় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা, ৫ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার টাকায় প্রশিক্ষণ ও ওয়ার্কশপ সেমিনার আয়োজন, ৯৭ লাখ ৪৯ হাজার টাকার পরামর্শক সেবা এবং ১ কোটি ১৯ লাখ ৫ হাজার টাকা এনজিও সহযোগী খাতে ব্যয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, কম্পিউটারসহ ক্রয়কৃত যন্ত্রপাতিগুলো সরবরাহ করা হবে এনজিও ইনস্টিটিউটগুলোতে। ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ বা সেমিনারে অংশগ্রহণকারী ও প্রদানকারীও এনজিও প্রতিষ্ঠান। পরামর্শক নিয়োগও করবে ইনাফি। এর পরেও এনজিওগুলোর জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১ কোটি ১৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এ প্রকল্পের বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের এবং সুবিধাভোগীদের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। এমতাবস্থায়, প্রকল্পটি সরকারি অনুমোদন প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে অনুমোদন করে বাস্তবায়ন করা যৌক্তিক বা নিয়মানুগ হবে না।
তা ছাড়া উন্নয়ন সহযোগী এই প্রকল্পে বাস্তবায়নকারী এনজিও ইনাফি নামক প্রতিষ্ঠানকে কেন নির্বাচিত করল এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়েছে কিনা। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য টিপিপিতে উল্লেখ করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের এ সব মন্তব্যের পর এডিবির বাংলাদেশ অফিস এবং বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পাস করিয়ে দিতে পরিকল্পনা কমিশনকে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে। এতে কাজ না হওয়ায় দেন-দরবার করে অবশেষে এটি অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসে। বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, এই প্রকল্পের সঙ্গে যাদের স্বার্থ জড়িয়ে আছে তারা পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানাভাবে ম্যানেজ করেছিলেন।
(দ্য রিপোর্ট/জেজে/এইচএসএম/সা/জানুয়ারি ২০, ২০১৪)