সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান ৫ জানুয়ারির ভোটে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সালমা ইসলামের কাছে পরাজিত হয়েছেন। দ্য রিপোর্ট- এর পক্ষ থেকে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম আওয়ামী লীগের এই কেন্দ্রীয় নেতার। আলোচনায় দশম সংসদ নির্বাচন, প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন তার কার্যক্রমের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। খোলামেলা কথা বলেছেন মান্নান খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদক বাহরাম খান

দ্য রিপোর্ট : বিগত সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছেন। এর কারণ কি?

মান্নান খান : আমার নির্বাচনী এলাকা দু’টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এখানে ২৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ২২টি ইউনিয়নে ভোটের দিক দিয়ে আমি এগিয়ে ছিলাম; প্রায় সাত হাজার ভোটে। একটি ইউনিয়নে আমাকে পরিকল্পিতভাবে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনারা জানেন একজন স্বনামধন্য ভূমি ব্যবসায়ী তার পত্রিকায় আমাকে নিয়ে অপপ্রচার করেছে। সেই ব্যক্তি অসম্ভব টাকা ছড়িয়ে ভোট কিনেছে। আমার এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি। অনেক জায়গায় বের করে দিয়েছে।

আপনারা জানেন, বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে অন্তত একজন হলেও নৌকার ভোটার আছে। অথচ ওই ইউনিয়নের প্রতিটি কেন্দ্রে নৌকার ভোট দেখানো হয়েছে ১৮ থেকে ২০টি। বিপরীতে লাঙ্গলে ভোট দেখানো হয়েছে দুই থেকে আড়াই হাজার। এটা কী কোনো গ্রহণযোগ্য ফলাফল হতে পারে?


দ্য রিপোর্ট : বাইশটি ইউনিয়নের ভোটে এগিয়ে থাকাকে একটিমাত্র ইউনিয়নের ভোটে ফলাফল উল্টে দেওয়া সম্ভব?

মান্নান খান : সম্ভব। কারণ ভোটের ব্যবধান ছিল খুবই কম। এ কারণেই একটি ইউনিয়নের ফলাফল দিয়ে নির্বাচনের পুরো ফল উল্টে দিতে পেরেছে।

দ্য রিপোর্ট : নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছেন?

মান্নান খান : হ্যাঁ করেছি।

দ্য রিপোর্ট : অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন কি পদক্ষেপ নিয়েছে?

মান্নান খান : বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে প্রক্রিয়াধীন আছে। আশা করি, কমিশন থেকে ন্যায় বিচার পাব।

দ্য রিপোর্ট : সুনির্দিষ্ট কি অভিযোগ করেছেন?

মান্নান খান : আমার আসনের সব ভোট পুনর্গণনার আবেদন জানিয়েছি। এবং অস্বাভাবিকভাবে যে সব কেন্দ্রে নৌকা প্রতীক আঠার-বিশ ভোট পেয়েছে সে সব কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছি।

দ্য রিপোর্ট : বাকি ২২টি ইউনিয়নে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মনে করেন?

মান্নান খান : আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে বলা যায়।

দ্য রিপোর্ট : আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে সালমা ইসলামের মতো প্রার্থীর সঙ্গে আপনার দৃষ্টিতে সুষ্ঠু হওয়া ২২ ইউনিয়নের ভোটে কি আপনি সন্তুষ্ট?

মান্নান খান : দেখুন, মীর জাফর, মোশতাক সব দলেই কম-বেশি থাকে। আমাদের দলের অনেক নেতা প্রকাশ্যে লাঙ্গলের পক্ষে কাজ করেছেন। এগুলোতে নেতিবাচক কাজ হয়েছে। প্রার্থী বা নেতা হিসেবে আমার ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু দল বা প্রতীকের সঙ্গে কোনো বেঈমানী সহ্য করা যায় না। দলের মধ্যে থেকে নিজ হাতে কুড়াল দিয়ে নৌকা ছিদ্র করা ইতিবাচক কাজ হতে পারে না।

দ্য রিপোর্ট : দলীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে?

মান্নান খান : আমার দলের সর্বোচ্চ পর্যায় বিষয়টি অবগত আছেন। তারা আমাকে একাধিকবার সতর্কও করেছেন। আমার অতীতের কার্যক্রমের কারণে কিছু ভূমিদস্যু শত্রুর ভূমিকায় কাজ করছে।

দ্য রিপোর্ট : আপনার দলের হাই-কমান্ড থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল বলে অনেকের আলোচনায় আমরা শুনেছি ...

মান্নান খান : জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাই। কারণ তিনি এমন একজন নেতা যিনি তার দলের নেতাকর্মীদের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করেন। তাই তার অনেক শত্রু। যে শক্তি বঙ্গবন্ধুকে তার দৃঢ়চেতা পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে বিপথে নিতে চেয়েছিল তারাই এ সব অপপ্রচার চালান।

দ্য রিপোর্ট : আপনি নিজেই বলেছেন আপনার আসনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সেই হিসেবে পুরো নির্বাচন নিয়ে যে সমালোচনা চলছে তার একটি গ্রহণযোগ্যতা তো তৈরিই হয়, না কি?

মান্নান খান : আমার এলাকায় কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী টাকার কাছে আত্মসমর্পণ করে ষড়যন্ত্র করেছে।

দ্য রিপোর্ট : তার মানে নির্বাচন কমিশন এ সব কাজে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি ...

মান্নান খান : আমি নির্বাচন কমিশনের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থাশীল। তারা আমার অভিযোগ আমলে নিয়ে সঠিক ফলাফল ঘোষণা করবেন।

দ্য রিপোর্ট : নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তো শপথ নিয়েছেন। আপনার অভিযোগ আমলে থাকলে তো কমিশন ফলাফল স্থগিত করতে পারত বা শপথ গ্রহণ স্থগিত রাখতে পারত। সে রকম তো হয়নি ...

মান্নান খান : দেখুন, কমিশনের এখনও তদন্ত করার এখতিয়ার আছে। আমি তাদের প্রতি আস্থাশীল।

দ্য রিপোর্ট : নতুন সরকার গঠন হল, আপনি কেমন দেখছেন?

মান্নান খান : জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা বাংলাদেশকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিবে বলে আমি আশা করি।

দ্য রিপোর্ট : দলীয় দপ্তর-সম্পাদক নিয়ে বির্তকের কথা শোনা যাচ্ছে। বিষয়টা আসলে কি?

মান্নান খান : মাননীয় নেত্রী আমাকে এই পদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এখনও আমি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। এখানে তো কোনো বির্তকের কারণ দেখি না।

মাননীয় নেত্রী প্রতিদিন আমাকে অফিসে এসে দায়িত্ব পালনের কথা বলেছেন। আমি সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। সম্প্র্রতি সংরক্ষিত মহিলা আসনের বিক্রিত ফরমে দপ্তর-সম্পাদক হিসেবেই স্বাক্ষর করেছি। নেত্রী আমাকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দপ্তর-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে যাব।

দ্য রিপোর্ট : সাংবাদিকরা আওয়ামী লীগের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরেক জনের নাম দপ্তর-সম্পাদক হিসেবে পাচ্ছে। এর কারণ কি?

মান্নান খান : এটা যিনি লিখেছেন তাকে জিজ্ঞেস করুন।

দ্য রিপোর্ট : এটা তো আপনাদের দলীয় দায়িত্ব। কোনো বিষয় নিয়ে যখন বির্তক দেখা দেয় তখন দলই এর সমাধান দিতে পারে। গঠনতন্ত্রে কি একাধিক দপ্তর-সম্পাদক হওয়ার সুযোগ আছে?

মান্নান খান : আমার জানা মতে দলীয় গঠনতন্ত্রে দপ্তর-সম্পাদকের পদ একটি। তারপরও যিনি নিজেকে দপ্তর-সম্পাদক হিসেবে দাবি করছেন তাকে প্রশ্ন করলে উত্তর পাবেন।

দ্য রিপোর্ট : আপনি গত কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতা হয়েছেন। তাই আপনার মতামত আগে জানতে চাই ...

মান্নান খান : আমার জানা মতে দলের একটা গঠনতন্ত্র আছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলন হয়। সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচন অথবা মাননীয় নেত্রী সর্বসম্মতভাবে পদ বণ্টন করেন। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।

দ্য রিপোর্ট : সাবেক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আপনার নিজের মূল্যায়ন জানতে চাইব ...

মান্নান খান : নবম সংসদে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ, কঠিন, জটিল ও দূরহতম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে দিয়েছিলেন। আমি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দিয়ে কাজ করেছি। আমি কতটুকু সফল হয়েছি, কতটুকু বিফল হয়েছি তা বিচার করার ভার আমি দেশবাসীর ওপর দিয়েছি।

আপনারা দেখেছেন হাতিরঝিলের মতো প্রকল্প ঢাকা শহরে এর আগে কেউ করতে পারেনি। কুড়িল ফ্লাই-ওভারের কাজ আপনারা দেখেছেন। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারসহ নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রমে ঢাকা আজ নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে।

হাতিরঝিলে গেলে মনে হয় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো কোনো দেশের রাস্তায় আছি আমরা।

সাইনবোর্ড লাগিয়ে জমি ব্যবসার অবৈধ কারবারের লাগাম টেনেছি। এতদিনে অনেক কৃষি জমি শেষ হয়ে যেত। আমাদের বাস্তবমুখী কার্যক্রমের কারণে তা অনেকাংশে রোধ হয়েছে।

দ্য রিপোর্ট : ড্যাপ (DAP) ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান তো বাস্তবায়ন হল না ...

মান্নান খান : আপনাকে ধন্যবাদ এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করার জন্য। কারণ, আমার মন্ত্রীত্ব থাকাকালীন সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে এই কাজটির অগ্রগতি করার চেষ্টা করেছি। ড্যাপ প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। ১৬ কোটি মানুষের বসবাস উপযোগী বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য ঊর্ধ্বমুখী বসবাস ব্যবস্থা অর্থাৎ বিশ থেকে পঞ্চাশ তলা বিল্ডিং তৈরির মাধ্যমে কৃষি জমিকে বাঁচানোর পরিকল্পনা আমরা করেছি।

ড্যাপ কোনো এক সরকার বা একক কোনো কাজ নয়। এর জন্য সবার আগ্রহ উদ্দীপক মনোভাব দরকার। কারণ ডিটেলস এরিয়া প্ল্যান একদিনে বাস্তবায়ন সম্ভব না।

(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এইচএসএম/সা/জানুয়ারি ২০, ২০১৪)