তৃণমূল নেতাদের ধরে রাখতে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি
তারেক সালমান ও মাহমুদুল হাসান, দ্য রিপোর্ট : তৃণমূল নেতাকর্মীদের আন্দোলনে ধরে রাখতে উপজেলা নিবার্চনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে বিএনপি। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে এমনটাই জানা যায়।
প্র্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ১০২টি উপজেলায় ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম এবং মার্চে দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, জাতীয় নির্বাচন আর স্থানীয় নির্বাচন এক নয়। স্থানীয় নির্বাচনে দলীয়ভাবে কাউকে সরাসরি সমর্থন দেয়া হয় না। তারপরও কেন্দ্র থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে একটা নির্দেশনা থাকে। উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে বিএনপি এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
জেনারেল মাহবুব বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য সরকারের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার। বর্তমান নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ নয়। পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনও সম্ভব নয়।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, তৃণমূল নেতাকর্মীরা জাতীয় নির্বাচনের জন্য রাজপথে আন্দোলনে দীর্ঘ দিন মাঠে থাকলেও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যর্থতার কারণে সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত ও বিরোধী দলের বর্জন উপেক্ষা করে সরকার একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার ঘটনায়ও নেতাকর্মীরা অনেকটা হতাশ হয়েছেন। এখন আবারও স্থানীয় নির্বাচন থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিলে পরবর্তী সময়ে সরকার পতন আন্দোলনে নেতাকর্মীদের মাঠে ধরে রাখা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে দলের হাইকমান্ডও ভেবে দেখছেন।
এজন্য দলের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগযোগ রাখা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে ছাড় দিলেও স্থানীয় নির্বাচনের কোনো ছাড় দিতে নারাজ দেশের প্রধান এই বিরোধী দল। এক্ষেত্রে বিগত সময়ে ঘোষণা দিয়ে বর্জন করা পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল ও নিরব সমর্থন দেয়া ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলকে আমলে নিচ্ছে বিএনপি।
দলীয়ভাবে পৌর নির্বাচন বর্জন করার পরও স্থানীয় পর্যায়ে নেতারা নিজেদের সিদ্ধান্ত ও প্রভাবে নির্বাচন করার পরও ক্ষমতাসীনদের চেয়ে বেশি পৌরসভায় বিএনপির স্থানীয় নেতারা বিজয়ী হন। তারপর ব্যাপক আলোচিত ৫ সিটি করপোরেশনে নির্বাচনেও বিএনপির প্রকাশ্য সমর্থনহীন ৫ প্রার্থীরাই সরকার দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। যদিও এসব সিটি করপোরেশনে নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চেষ্টা করা হয়। এসব বিষয়কে আমলে নিয়ে উপজেলা নির্বাচন নিয়েও ব্যাপক গুরুত্ব সহকারে দেখছে দলটি।
উপজেলা নির্বাচনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিএনপির প্রতি জনসমর্থন আদায় করে সরকার পতন আন্দোলনকে আরও জোরালো ও তাকে কাজে লাগাতে চায় দলটি। পাশাপাশি আন্দোলনে নেতাকর্মীদের ধরে রাখার চেষ্টাতো রয়েছেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
জানা যায়, জাতীয় নির্বাচনের জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখতে চায় বিএনপি। দলটির অভিমত, সিটি নির্বাচনে জনগণ ও সংবাদ মাধ্যমের প্রবল আগ্রহের কারণে পক্ষপাতদুষ্ট কমিশন কোনো কারসাজি করতে সাহস পায়নি। উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরেও কমিশনের উপর তেমন চাপ সৃষ্টিরই কৌশল তৈরি করবে বিএনপি। এছাড়া, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার ও কমিশনকে পরিবেশ তৈরি করতেও চাপ সৃষ্টি করবে দলটি।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর ২২ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাচন হয়। নবম জাতীয় নির্বাচনে ১৮ দলের ভরাডুবি হলেও সারাদেশে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের অধিকাংশ নেতারাই জয় লাভ করে। এছাড়া ৫ সিটি করপোরেশেন নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয় পায় বিএনপি। এটি ধরে রেখে উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় স্থানীয় নেতারা।
তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে রাজনৈতিকভাবে মাঠ ধরে রাখা কঠিন হবে। তৃণমূলে বিএনপির আন্দোলন সফল হয়েছে। এটা ধরে রাখতে হবে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা সফল হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের পাশপাশি উপজেলা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। যার প্রভাব পরবর্তী সময়ে জাতীয় নির্বাচনের উপর পড়বে।
খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু ইউসূফ চৌধুরী দ্য রির্পোটকে বলেন, কেন্দ্র থেকে এখনও কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। তবে যেহেতু তারা না বলেনি, সেহেতু আমরা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে। অনেক নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। যারা প্রার্থী হবে তাদের অনেকে এলাকায় যেতে পারছেন না। নিজেদেরই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
ইউসূফ বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। তবে, সমতল ভূমি ও পার্বত্য এলাকার প্রেক্ষাপটে তফাত রয়েছে। আওয়ামী লীগ কারচুপির আপ্রাণ চেষ্টা করবে, আমরা জানি। তারপরও স্থানীয়রা ও দেশবাসী সব দেখবে।
এক প্রশ্নের জবাবে জেলা বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমাদের লোকজনদের ধরে রাখতে হবে। মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই খাগড়াছড়ির পাঁচটি উপজেলাতেই বিএনপির প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হবে। কমিশনের সহায়তায় আওয়ামীলীগ কোনো কারসাজি করলে স্থানীয় জনগণ ছেড়ে দেবে না, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখি আমরা।’
টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল দ্য রিপোর্টকে উপজেলা নির্বাচন সম্পর্কে বলেন, ‘রাজনীতি করি, জনগণের সেবা করার জন্য। আর সেবা করতে চাই জনপ্রতিনিধি হিসেবেই। উপজেলা নির্বাচনের তফসিল নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে। এখন দলের নির্দেশনা পেলে অবশ্যই নির্বাচন করবো। আওয়ামী লীগকে খালি মাঠে গোল দিতে দেব না।’
ফরহাদ বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। তাদের দ্বারা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। তারপরও দল যদি নির্বাচনের নির্দেশ দেয়, তবে নির্বাচনে কোনো ধরণের কারসাজি করার চেষ্টা করলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিরোধ করা হবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক নেতা মাহবুবুল হক চৌধুরী (ভিপি মাহবুব) উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, দল নির্বাচনের অনুমোদন দিলে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে আমি নির্বাচন করবো। দলের নির্দেশনা পেলে নির্বাচনের জন্য আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বর্তমান অবৈধ সরকারের আজ্ঞাবহ কমিশনের প্রতি আস্থা না থাকলেও জনগণের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগকে জনগণ আর দেখতে চায় না। তারা পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে। আমরা খালি মাঠে গোল দিতে দেব না।
গাজীপুর জেলার কাপাশিয়া উপজেলা ওলামা দলের সভাপতি মাওলানা সিদ্দিক হোসাঈন দ্য রির্পোটকে বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা পেলে নেতারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিবেন।’
সিদ্দিক বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে না পেরে অনেক নেতাই হতাশ হয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচনে যেহেতু দলীয় সমর্থন সরাসরি লাগে না সেক্ষেত্রে নির্বাচনের জন্য অনেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জানা যায়, কাপাশিয়া উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে বিএনপির সভাপতি ও তরগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান ও বিএনপি নেতা মমতাজ উদ্দিন দুলুর নাম শোনা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বেশ কিছু উপজেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হবে। বর্তমানে উপজেলার সংখ্যা ৪৮৭টি। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি দেশের ৪৮০টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
(দ্য রির্পোট/টিএস-এমএইচ/ এমডি/ জানুয়ারি ২২, ২০১৪)