মস্তকবিহীন লাশ
হত্যার সঙ্গে পুলিশ সম্পৃক্ত!
রাজধানীর পল্টন থানা সংলগ্ন ট্রাফিক পুলিশ ব্যারাকের ছাদে যুবক হত্যার ঘটনায় পুলিশ সদস্যরা সম্পৃক্ত রয়েছে। নারীঘটিত কারণ কিংবা টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। প্রাথমিকভাবে এমনই ধারণা করছেন- তদন্তকারী সংস্থার সদস্যরা। অন্যদিকে, এই ঘটনায় ৪ পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ট্রাফিক পুলিশের ব্যারাক ভবনের ছাদে যুবক হত্যার ঘটনায় হতাশ খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। নারীঘটিত কোনো কারণ কিংবা টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বহিরাগতরাও অংশ নিতে পারে। এ ধরনের একটি নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ব্যারাকে বসবাসরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘রাতের কোনো এক সময় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের সম্পৃক্তের বিষয়টি আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। ওই ব্যারাকে পুলিশের এসবি, ডিবি, সিআইডি ও ট্রাফিক সদস্যরা বসবাস করেন।’
হঠাৎ এ ধরনের ঘটনা একটু চিন্তার বিষয়। নিহতের পরিচয় পাওয়া গেলে হত্যার রহস্য উদঘাটন সম্ভব হবে বলে জানান আশরাফুজ্জামান।
আশরাফুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ওই যুবক হত্যার ঘটনায় ৪ পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে হত্যার ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততার সন্দেহে পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে কিছু বিষয় নিশ্চিত হলে তাদের গ্রেফতার দেখানো হতে পারে।
জানা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি এক পুলিশ সদস্যকে আটক করা হয়েছে। আটক সওকত হোসেন পুলিশ কনস্টেবল।
পল্টন থানার ডিউটি অফিসার শ্যামল দেবনাথ বলেন, ‘পুলিশের কনস্টেবল সওকতকে আটক করার খবর পাওয়া গেছে। তবে তাকে থানায় রাখা হয়নি। মতিঝিল বিভাগের উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডিবি পুলিশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সব কিছু পরিষ্কার করা হবে।’
পল্টন থানার ওসি মোরশেদ আলম জানান, সকাল ১০টার দিকে পাশের উঁচু ভবন থেকে ট্রাফিক পুলিশ ব্যারাকের ছাদে একজন যুবককে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পাশের ভবনের লোকজন চিৎকার করলে ব্যারাকের পুলিশ সদস্যরা জানতে পারেন ছাদের উপর কেউ পড়ে আছে।
খবর পেয়ে পল্টন থানা পুলিশ গিয়ে দেখতে পায়, ভবনের পশ্চিম পাশে পানি ট্যাঙ্কির কাছে মস্তকহীন এক যুবকের লাশ পড়ে আছে। তার পেটে একটি ও হাতে দুইটি ধারাল অস্ত্রের আঘাত। সুরতহাল প্রতিবেদন শেষে বিকেল তিনটার দিকে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। মৃতদেহ মেডিকেল কলেজের হিমাগারেই রাখা হবে।
ওসি আরও জানান, লাশের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। হত্যাকাণ্ডের কারণ সর্ম্পকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, নারীঘটিত কোনো কারণ কিংবা টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ওই ভবনে কাউকে যেতে হলে পল্টন থানার গেট কিংবা উত্তর পাশে পুলিশের স্টাফ কোয়ার্টারের ভেতর দিয়ে ঢুকতে হবে। ভবনটির নিচতলায় একটি ক্যান্টিন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় থাকেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের খেলোয়াড়, ওয়ার্কশপকর্মীসহ অন্যরা থাকেন।
ছাদের পশ্চিম পাশে গিয়ে দেখা যায়, পানির ট্যাঙ্কির পাশে সুঠামদেহী এক যুবকের মস্তকহীন লাশ চিৎ হয়ে পড়ে আছে। দুই হাত দুই পাশে ছড়ানো। তার পেটের ডান দিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। বাম হাতে দুইটি কোপের দাগ। পরনে কালো গেঞ্জি ও ট্রাউজার। মৃতদেহের পাশে ছোপ ছোপ রক্ত। চিৎ হয়ে পড়ে থাকা লাশের পাশেই একটি আংটি পড়ে আছে। পুলিশের ধারণা, আংটিটি খুনির।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘এ ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় কীভাবে খুনের ঘটনা ঘটলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে। সিআইডি লাশের ডিএনএ সংগ্রহ করেছে। পুলিশ সদস্যরা হত্যার ঘটনায় জড়িত রয়েছে কিনা সে বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত চলছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ সদস্য জানান, যে ভবনে পুলিশ সদস্য থাকে সেখানেই নিরাপত্তা নেই। ভবনে ঢোকার জন্য আগে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নেই। সাধারণ মানুষও ভবনে যে কোনো সময় ঢুকছে, বের হচ্ছে। পুলিশ ব্যারাকের ছাদে জবাই করে লাশের মস্তক নিয়ে যাওয়ায় তারা নিজেরাই এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, ট্রাফিক ব্যারাকের পুরো এলাকার সকল পানির ট্যাংক ও ঝোপ-জঙ্গল খোঁজা হয়েছে। কোথাও মৃতদেহের মস্তক পাওয়া যায়নি।
ডিবি কর্মকর্তা গোলাম রব্বানি জানান, মাথা না থাকার কারণে লাশ শনাক্ত করা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত মাথা পাওয়া না গেলে মহানগর পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগের জনবল গণনা করা হবে। গণনা শেষে জানা যাবে ওই ব্যক্তিটি পুলিশ না সাধারণ কেউ। ঢাকা মহানগরের প্রত্যেক থানায় খবর দেওয়া হয়েছে। কোনো মস্তক পাওয়া গেলে এই লাশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে।
ওই ভবনের বাসিন্দা ট্রাফিক পুলিশের সদস্য মাসুদ বলেন, এখানে সাধারণ লোক প্রবেশ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ভবনটি ট্রাফিক পুলিশের জন্য বরাদ্দ থাকলেও পুলিশের অন্য বিভাগের সদস্যরাও এখানে থাকেন।
তিনি বলেন, ভবনের নিচতলায় পুরোটাজুড়ে ক্যান্টিন, দুই ও তিন তলায় পুলিশের গাড়িচালক, আর চার ও পাঁচ তলায় ডিবি ও এসবি পুলিশের কর্মকর্তারা থাকেন।
(দ্য রিপোর্ট/কেজেএন/এইচএসএম/আরকে/সা/জানুয়ারি ২২, ২০১৪)