চা বিক্রেতা রফিকের সোনামনি পাঠশালা
আব্দুর রব নাহিদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ : শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঝিলিম ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নেরই একটি গ্রাম ঠাকুর পালশা।
গ্রামটির অধিকাংশ মানুষই জড়িত চাষবাসের সঙ্গে। শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে খুব একটা ভাবনা নেই তাদের। সেজন্যই হয়তো গ্রামটিতে ছিল না কোনো স্কুল।
আর এই বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে পড়ালেখা না জানা চা বিক্রেতা রফিকুল ইসলামকে। স্বপ্ন দেখেন এই গ্রামে চালু হবে একটি স্কুল। শিক্ষায় আলোয় জীবনের পথ দেখবে গ্রামের কোমলমতি শিশুরা।
তার এই স্বপ্নের কথা গ্রামের অনেকের কাছে বলেন তিনি। সবাই তার এই স্বপ্নকে পাগলামী বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু হাল ছাড়েননি রফিক। জমানো কিছু টাকা আর পোষা একটি গরু বিক্রি করে নিজেই শুরু করেন স্কুল স্থাপনের কাজ।
গ্রামের এক প্রান্তে এক টুকরো ফসলের জমি ৩৬ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে ২০১৩ সালের ২ এপ্রিল শুরু হয় রফিকের স্বপ্ন পূরণের সংগ্রাম। গড়ে ওঠে সোনামনি পাঠশালা।
তবে রফিক বিপাকে পড়েন শিক্ষক নির্বাচন নিয়ে। তিনি তো লেখাপড়া জানেন না। তাহলে কে পড়াবে সোনামনি পাঠশালায়? তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন ওই গ্রামেরই মেয়ে মরিয়ম আক্তার। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের শাহনেয়ামতুল্লাহ কলেজের ডিগ্রী দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। স্কুলের বাচ্চাদের পড়ানোর কাজটি মরিয়মই করেন।
ঠাকুর পালশা গ্রামে রফিকের সেই স্বপ্নের সোনামনি পাঠশালায় গিয়ে দেখা যায় চারিদিকে ফসলের মাঠ হলুদ সরষে ফুল মাঝখানে বাঁশ আর চাটাইয়ের বেড়া দেওয়া দুটো টিনের চালাঘর। সামনে পটপট করে উঠছে লাল সবুজের পতাকা। একটু কাছে যেতেই দেখা গেল ছোট একটি সাইন বোর্ড। তাতে লেখা সোনামনি পাঠশালা। শ্রেণি কক্ষে নেই কোনো চেয়ার টেবিল কিংবা বেঞ্চ। চট বিছিয়ে চলছে লেখাপড়া ।
গ্রামের হত দরিদ্র পরিবারের অন্তত ৫০ জন শিশু লেখাপড়া করে সোনামনি পাঠশালায়।
কথা হয় স্কুলের একমাত্র শিক্ষক মরিয়মের সঙ্গে। মরিয়ম আক্তার জানান, পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুদের পড়াতে তার ভালই লাগে।
তিনি আরও বলেন, ‘ আমাদের গ্রাম থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অনেক দূরে হওয়ায় অনেক শিশুই আগে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেত না। রফিক ভাই এই স্কুল করাতে গ্রামের সবার জন্য ভালো হয়েছে।’
কিভাবে স্কুল পরিচালনার খরচ যোগান জানতে চাইলে রফিক জানান, বাচ্চাদের কাছ থেকে মাসে ২০ ও ৪০ টাকা করে তোলা হয়। তবে অনেকেই তা দিতে পারে না। পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা উঠলে তা শিক্ষক মরিয়মকে দেন তিনি। আবার কোন মাসে মরিয়মকে কিছুই দেওয়া সম্ভব হয় না।
তার চায়ের দোকান থেকে যে আয় হয় তা থেকে সংসার চালানোর পাশাপাশি স্কুলের কিছু খরচেরও যোগান দেন তিনি।
তবে স্বপ্নচারী এ মানুষটি স্কুলের খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। স্কুলের টিন কেনার আট হাজার টাকা দোকানে বাকি রয়েছে বলে জানান রফিক।
তাছাড়া ১০ বছর পর স্কুলের জমির লিজের মেয়াদ শেষ হলে মালিক জমি নিয়ে নেবে। এরপর কী হবে ভেবে শঙ্কিত রফিক।
তবে আশাবাদী রফিক জানান, ‘আমি যদি স্কুলটি ভালভাবে দাঁড় করাতে পারি তাহলে ১০ বছর পর এই জমি স্কুলেরই হবে।’
তিনি আশাবাদী গ্রামবাসী চাঁদা তুলে হলেও জমিটি স্কুলের জন্য কিনে দেবে। তা না হয় তাহলে অন্তত সরকার জমিটি কিনে স্কুলটি চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে।
তিনি জানান, সবার সহযোগিতা পেলে বাচ্চাদের জন্য বেঞ্চ ও চেয়ার টেবিল কেনা সম্ভব হবে।
স্কুলের জন্য এখন পর্যন্ত সরকারি আর্থিক অনুদান পাননি রফিক। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই তিনি স্কুলটি চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে চলতি বছর শাহনেয়ামতুল্লাহ কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলামের সহযোগিতায় প্রথম শ্রেণির জন্য নতুন বই উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে পেয়েছেন।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুস সাত্তার জানান, কারও ব্যক্তিগতভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার সুযোগ নেই। সরকার প্রয়োজন মনে করলে সেখানে বিদ্যালয় করবে।
তবে সোনামনি পাঠশালার বিষয়টি জানতেন না বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি খোঁজ নেব। সেখানে যদি আরও বই এর প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে আমরা সরবরাহ করতে পারি।’
রফিকের স্বপ্ন সরকার ও গ্রামের সবার সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যাবে সোনামনি পাঠশালা। শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেবে গ্রামের প্রতিটি ঘরে।
(দ্য রিপোর্ট/এআরএন/কেএন/আরকে/জানুয়ারি ২২, ২০১৪)