বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে কঠিন শর্তে ঋণ নিচ্ছে সরকার। সহজ শর্তে চাহিদা মতো ঋণ না পাওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার এ পথে হাঁটছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এক্সটেনশন অফ বড়পুকুরিয়া কোল ফায়ারড থার্মাল পাওয়ার স্টেশন বাই ২৭৫ মেগাওয়াট (তৃতীয় ইউনিট) প্রকল্পে সরকার কঠিন শর্তে ঋণ নিচ্ছে। এ ঋণ নেওয়া হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কর্মাশিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি) থেকে। এ ঋণে সুদের হার ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, এর সঙ্গে ম্যানেজমেন্ট ফি ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ ও কমিটমেন্ট ফি ১ শতাংশ হারে ধরা হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৬৮৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কর্মাশিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি) ঋণ হিসেবে দেবে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৬৪৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ব্যয় করবে ২০৪ কোটি ৪ লাখ টাকা।

২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সিং-এর অর্থায়নের মাধ্যমে বড়পুকুরিয়া ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটি টার্ণকীভিত্তিতে বাস্তবায়নের অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সর্বনিম্ন দরদাতা জয়েন্ট ভেনচার হারবিন ইলেকট্রিক ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড এবং সিসিসি ইঞ্জিনিয়ারিং পিআর চায়নার দর প্রস্তাব অনুমোদন পায়। ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল অর্থবিভাগ প্রকল্পটি টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সিং-এর মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে সভরেন গ্যারান্টি দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে প্রতিবছর বিদ্যুতের চাহিদা ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক প্রধান জ্বালানি গ্যাসের মজুদের পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। তাই বিকল্প উৎস হিসেবে স্বল্প ব্যয়ের জ্বালানি যেমন- কয়লা, লিকুইড ফুয়েল, হাইড্রোপাওয়ার ইত্যাদি উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে কয়লাভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করলে বড়পুকুরিয়ার কয়লা ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বড়পুকুরিয়ার বিদ্যমান ২৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রে আরও একটি ২৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের তৃতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কঠিন শর্তে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) বক্তব্য হচ্ছে- কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতেই দাতাদের কাছ থেকে অনমনীয় শর্তে ঋণ নেওয়া হচ্ছে ।

ইআরডির অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খান বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে এবং সে লক্ষ্যেই কাজ করা হচ্ছে। এটি করতে হলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার তা শুধুমাত্র সফট লোনের (সহজ শর্তের ঋণ) ওপর নির্ভর করলে হবে না। মধ্য আয়ের অর্থনীতির লক্ষ্য পূরণ করতেই বিদ্যুতসহ বিভিন্ন প্রকল্পে অনমনীয় শর্তে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। এটি খুবই স্বাভাবিক বিষয়।’

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কঠিন শর্তে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে কড়াকড়ি থাকলেও সরকার বিভিন্ন করপোরেশন উন্নয়নের নামে একের পর এক ঋণ নিচ্ছে। দিন দিন কঠিন শর্তে নেওয়া এ সব ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।

যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে মনে করে সম্প্রতি কঠিন শর্তের ঋণ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা জারি করেছে সরকার।

সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মতো অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অবকাঠামো খাতসহ সরকারের উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সরকারি মালিকানাধীন কয়েকটি করপোরেশনের কার্যক্রম সম্প্রসারণে কঠিন শর্তে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। সহজ শর্তের ঋণের তুলনায় উচ্চ সুদের হার ও স্বল্প সময়ে পরিশোধের বাধ্যবাধ্যকতা থাকায় অনমনীয় ঋণ পাবলিক খাতে সামগ্রিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। দেশে বৈদেশিক উৎস হতে নমনীয় ঋণের চেয়ে কঠিন শর্তের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, যে সব ঋণে ৩৫ শতাংশের উপরে গ্যান্ট এলিমেন্ট থাকে সেগুলোকে বলা হয় সফট লোন। এর সঙ্গে গ্রেস পিরিয়ড, ঋণ পরিশোধের সময় এবং সুদের হার ইত্যাদি যুক্ত থাকে। কিন্তু যে সব ঋণে গ্যান্ট এলিমেন্ট ৩৪ শতাংশ থাকে সেগুলোকে হার্ডটার্মও বলা যায় না আবার সফট লোনও বলা যায় না। এ রকম সমস্যা দূর করতে নীতিমালা করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রকাশিত বৈদেশিক ঋণ অনুমোদনের নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনমনীয় বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে যে সকল প্রকল্প বা পণ্য সংগ্রহে অর্থায়ন সম্ভব হয়নি বা অতীত রেকর্ড অনুযায়ী সম্ভবপর নয়, সে সব ক্ষেত্রে অনমনীয় ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন বিবেচনা করা হবে। যে সকল ঋণের ক্ষেত্রে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি প্রয়োজন সে সকল ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় হতে ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা না থাকলে তাদের অনমনীয় ঋণের প্রস্তাব নিরুৎসাহিত করা হবে, তবে জাতীয় স্বার্থের জন্য অপরিহার্য হলে তা বিবেচনা করা যেতে পারে। ডাউন পেমেন্টের বাধ্যবাধকতার শর্তযুক্ত ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন নিরুৎসাহিত করা হবে। যে সব অর্থবছরে অনমনীয় বৈদেশিক ঋণের ডেবিট সার্ভিসিংবাবদ সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের রফতানি আয়ের ১০ শতাংশ অথবা রাজস্ব আয়ের ১৫ শতাংশ এ দু’টির মধ্যে যেটি কম তার মধ্যে সীমিতকরণ করতে হবে। এ ছাড়া অনমনীয় বৈদেশিক ঋণের স্থিতি জিডিপির ১০ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে।

(দ্য রিপোর্ট/জেজে/ডব্লিউএন/এইচএসএম/সা/জানুয়ারি ২৩, ২০১৪)