ট্রাফিক পুলিশ ভবনের ছাদে লাশ
নান্নুকে একাই হত্যা করেন শওকত!
রাজধানীর ট্রাফিক পুলিশ ভবনের ছাদে কথিত কবিরাজ নান্নু মুন্সিকে একাই হত্যা করেছে শওকত হোসেন। প্রাথমিক পর্যায়ে হত্যার ঘটনায় অন্য পুলিশ সদস্যদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ ছিল। পরবর্তী সময়ে জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এ ঘটনায় অন্য কেউ জড়িত নন, শওকত একাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
এদিকে ট্রাফিক ভবনের ছাদ থেকে মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার ও নিহত ব্যক্তি নান্নু মুন্সির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে আছেন শওকতের স্ত্রী খুশি আক্তার। তার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে গিয়েও তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
মতিঝিল জোনের পুলিশের উপ-কমিশনার আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘ট্রাফিক ভবন থেকে উদ্ধার করা মস্তকবিহীন লাশের রহস্য উদঘাটন শেষ পর্যায়ে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত শওকত একাই জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাই ওই ব্যারাকে অবস্থানরত অন্য কোনো পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ বা শোকজ করা হয়নি। তবে ঘটনার সঙ্গে অন্য কেউ জড়িত থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদ আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কবিরাজ নান্নু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ কনস্টেবল শওকত একাই জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এ ঘটনায় আরও কেউ জড়িত রয়েছে কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শওকতকে ৩ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে এ ঘটনার সকল তথ্য উদ্ধার করা হবে।’
ওসি বলেন, ‘আটকের পর শওকত বিভিন্ন বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এক পর্যায়ে সে ভুল স্বীকার করে পুলিশকে তথ্য দিয়ে তদন্ত কাজে সহায়তা করেছে। প্রথমে নিহতের মাথা উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে ভিকটিমের খোয়া যাওয়া মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি রয়েছে হত্যার কাজে ব্যবহৃত ছুরি। ছুরিটি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।’
ডিএমপি সূত্র জানায়, মো. শওকত আলী ১৯৭৬ সালের ২০ জুলাই ঝিনাইদহ থেকে এসএসসি পাস করেন। তার বাবার নাম সুলতান আহমেদ। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ থানার সানবান্ধা গ্রামে। তিনি ১৯৯৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। চাকরি শুরুর দিকে পঞ্চম এপিবিএন খুলনায় ও নবম এপিবিএন ঢাকার উত্তরায় কর্মরত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) যোগদান করেন এবং ২০১০ সালের ২৪ মার্চ পরিবহন বিভাগে যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) বিভাগে গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ সময় স্ত্রীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক বরখাস্ত হন শওকত। এরপর তিনি স্ত্রীর সঙ্গে আপোস করতে বিভিন্ন সময় ফকির-কবিরাজের কাছে ধর্না দেন।
এদিকে গ্রেফতার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে শওকতের স্ত্রী (ডিভোর্সি) খুশি আক্তার। গত দু’দিন থেকেই তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। দ্য রিপোর্টের ঝিনাইদহ সংবাদদাতা তার বাসায় গিয়েও কোনো খোঁজ পাননি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঘটনার পরপরই খুশি আক্তার ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।
পুলিশ কনস্টেবল শওকতের চাচা মোজাম্মেল হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আজকের পরিস্থিতির জন্য শওকত দায়ী নয়। এ ঘটনার সব দায় শওকতের স্ত্রী খুশি আক্তারের।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘শওকতরা ৩ ভাই ও ২ বোন। ভাইদের মধ্যে শওকত বড়। তাদের সংসারে কাল হয়ে দাঁড়ায় খুশি।’
শওকতের অতীত ইতিহাস তুলে ধরে মোজাম্মেল বলেন, ‘শওকত পুলিশের চাকরি করার সময় ঢাকায় খুশি আক্তারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ২০০২ সালের শেষের দিকে তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় খুশি আক্তার দুই সন্তানের জননী ছিলেন। অন্যের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও শওকত খুশির সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। গর্ভবতী অবস্থায় ২০০৩ সালে শওকতকে বিয়ে করতে বাধ্য করেন খুশি। ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে তাদের বিয়ে হয়। এ বিয়ের পর পরই শওকতের পরিবারে কলহ শুরু হয়। এক পর্যায়ে শওকত তার পরিবার ছেড়ে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগের সংসারের তিন সন্তান ও নিজের এক সন্তান নিয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছিল শওকত। এ সময় দুই বছরের জন্য মিশনে দেশের বাইরে যান শওকত। বিদেশ থেকে তিনি স্ত্রীর কাছে টাকা পাঠাতেন। এ টাকা দিয়ে কোটচাঁদপুরে খুশি আক্তার নিজের ও স্বামীর নামে ১০ কাঠা জায়গা কিনে সেখানে দোতলা বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে। এ ছাড়াও নিজ নামে বিভিন্ন এলাকায় আরও ১০ লাখ টাকার সম্পদ গড়েন খুশি। এ সব কাজে তাকে সহায়তা করেন এক ইউপি মেম্বার। কিছুদিন পরে ওই মেম্বারের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে যান খুশি। শওকত দেশে ফিরলে এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে শওকতকে তার স্ত্রী ডিভোর্স দেয়। কিন্তু শওকত তা মেনে না নিয়ে আপোস করার চেষ্টা করে। এ সময় শওকতের স্ত্রী পুলিশের কাছে আবেদন করে। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক বরখাস্ত হন শওকত।’
তিনি বলেন, ‘শওকত এ সব বিষয়ে কবিরাজ নান্নুর সহায়তা চান। এক পর্যায়ে নান্নু কবিরাজি করতে শওকতের স্ত্রীর কাছে যান। যাওয়া-আসা ও কবিরাজির মধ্যে দিয়ে প্রায় দুই বছর কেটে যায়। শওকতের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নান্নু টালবাহানা শুরু করে। অপরদিকে নান্নু নিজেই শওকতের স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ সব বিষয়ে মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছিল শওকত।’
স্ত্রী, সন্তান ও অর্থ হারানোর ক্ষোভ তাকে হত্যাকারীর ভূমিকায় আসতে বাধ্য করেছে বলেও দাবি করেন মোজাম্মেল হোসেন।
(দ্য রিপোর্ট/কেজেএন/এসকে/সা/এইচএসএম/জানুয়ারি ২৩, ২০১৪)