দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ‘তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন।’ (সূরা হা মীম সিজদা; ৩৩) এছাড়া রাসুল (সা.) বলেছেন, 'বাল্লিগ আন্নি ওয়া লাও আয়াহ্‌।' অর্থাৎ, আমার একটি বাক্যও (আয়াত) যদি পারো মানুষের মধ্যে পৌঁছে দাও।

তাবলীগ’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো প্রচার করা, প্রসার করা, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া, বয়ান করা, প্রচেষ্টা করা বা পৌঁছানো প্রভৃতি। পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌছানো বা অন্যকে শিক্ষা দেয়াকে তাবলীগ বলা হয়। তাবলীগ এক নিরলস সংগ্রাম ও সাধনার নাম। তাবলীগের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পরিচয় ও সম্পর্ক হওয়া, যাতে তার কাছ থেকে মানুষ সব সমস্যার সমাধান লাভ করে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি সফলতা পায়। ধর্মপ্রাণ মানুষ আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে সমাজজীবনে নানারকম দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, হত্যাকাণ্ড নির্যাতন, অন্যায়-অত্যাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, বিশৃংখলা, মিথ্যা বলা, অন্যের ক্ষতি করা প্রভৃতি সামাজিক অনাচার থেকে বিরত থাকতে পারেন। মূলত ইসলাম ধর্মের মৌলিক নীতি, আদর্শ ও শিক্ষাবলী অন্যের কাছে সহজভাবে পৌছে দেয়াই হলো তাবলীগ।

‘ইজতেমা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সমবেত করা, সভা সমাবেশ বা সম্মেলন। ধর্মীয় কোন কাজের জন্য বহুসংখ্যক মানুষকে একত্র করা, কাজের গুরুত্ব বোঝানো, কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ব্যাপকভাবে এর প্রচার প্রসারের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়কে পরিভাষায় ধর্মীয় ইজতেমা বলা হয়। ‘তোমার কাছে যদি কোন বাণী থাকে তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিঃসৃত এ শাশ্বত বাণীকে আহ্বান করে ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ মহাসম্মেলনে সমবেত হন। একই সঙ্গে মিলিত হন বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ থেকে আগত হাজার হাজার তাবলীগ অনুসারী ঈমানদার মুসল্লী। তারা কোনরকম বৈষয়িক লাভের আশা না করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনের মেহনত করে ইজতেমা ময়দানকে মুসলিম মহামিলনের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন।



মুসলমানরা চিন্তাগতভাবে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু মূলগতভাবে তারা এক কালেমা ও ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের ধারণায় বিশ্বাসী। যা তাদের জন্য বড় শক্তি। ইসলাম একটি প্রচারধর্মী (মিশনারী) ধর্ম। কিন্তু অপরের কাছে প্রচারের আগে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাওহিদের শক্তিতে বলীয়ান হতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা।

বিশ্ব ইজতেমা তাবলীগ জামাতের সবচেয়ে বড় সম্মেলন। আবার অন্যদিক থেকে হজ্বের পর ইসলামী দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জমায়েত। বিশ্ব ইজতেমায় পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ থেকে মুসলমানরা অংশগ্রহণ করেন। নানা মাজহাব এবং মত ও পথের মুসলমানরা এখানে হাজিরা দেন। একই শামিয়ানার নিচে অবস্থান করেন। প্রতিবছর শীতকালে (ডিসেম্বর/জানুয়ারি) ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

তাবলীগ জামাতের ইতিহাসে এই ধরনের সমাবেশের নজির প্রথম থেকেই রয়েছে। ১৯১০ সালে ভারতবর্ষের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা ইলিয়াছ কান্দলবী (র.) তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন রাজস্থানের মেওয়াত নামক এলাকা থেকে। একইসঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মেলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন। বাংলাদেশে ১৯৫০ এর দশকে তাবলীগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ। বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে বিশ্ব ইজতেমা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়।

১৯৪৬ সালে প্রথম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় কাকরাইল মসজিদে। ১৯৪৮ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের হাজিক্যাম্পে এবং ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর রেল স্টেশনের পাশে পাগাড়ে অনুষ্ঠিত ইজতেমায় সর্বপ্রথম বাংলাদেশ ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশের মুসুল্লী অংশগ্রহণ করেন। স্থান সংকুলানে সমস্যা হলে পরের বছর অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে টঙ্গীর কহরদরিয়া বা তুরাগ নদীর পূর্ব তীরে। এ খোলা ভূমি ছিল রাজউকের হুকুম দখলকৃত জমি। তুরাগের পাড়ে ১৬০ একর জায়গায় ১৯৬৭ সাল থেকে দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে একই স্থানে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তারপরও স্থান সংকুলান বড় সমস্যা হিসেবে থেকে গেছে। তাই ২০১১ সালে থেকে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উল্লেখ্য ১৯৯৬ সালে একই বছর দুইবার বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

সাধারণত তাবলীগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন তিন দিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত করে থাকেন। সে হিসাবে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিন দিন জুড়ে। এই তিন দিনের মধ্যে শুক্রবারকে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। শুক্রবার ফজর নামাজের আ'ম বয়ান বা উন্মুক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হয় ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা এবং আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়। অনেকে শুধু জুমা'র নামাজ কিংবা আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেন আখেরি মোনাজাতে। সরকার প্রধান (প্রধানমন্ত্রী), রাষ্ট্রপ্রধান (রাষ্ট্রপতি), বিরোধী দলীয় নেতাসহ অন্যান্য নেতা-নেত্রীরা আখেরি মোনাজাতে আলাদা-আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করেন।

ইজতেমা মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যকে লালন করে আসছে। আল্লাহ উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। ইজতেমায় সে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ইসলামের আর্দশ সামনে রেখে এখানে কোনো মুসলমানকে ছোট করে দেখা হয় না। আল্লাহর কাছে প্রত্যেক মুসলমানের মূল্য আছে- এখানে এটা ভালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। মুসলমানদের কোনো ভাগে বিভক্ত করা হয় না। এক মুসলমান যেন আরেক মুসলমানকে সম্মান করে সে জন্য জোর তাগিদ দেওয়া হয়। কোনো মাজহাবের মুসলমানকে খাটো করা হয় না। বরং সবাইকে ঈমান ও আমলের মেহনতের প্রতি আহ্বান করা হয়। তারা একই প্লেটে খাবার খান, একইসঙ্গে ঘুমান। কারও মধ্যে কোনো হিংসা, ঘৃণা থাকে না। সাদা-কালোর পার্থক্য থাকে না। সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী সকল মানুষের চাওয়া-পাওয়া এক হয়ে যায়।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/একেএম/জানুয়ারি ২৪, ২০১৪)