দাওয়াতের পথ ও পদ্ধতি
দ্যা রিপোর্ট ডেস্ক : তাবলীগ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো প্রচার করা, প্রসার করা, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া, বয়ান করা, প্রচেষ্টা করা বা পৌঁছানো প্রভৃতি। পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌছানো বা অন্যকে শিক্ষা দেয়াকে তাবলীগ বলা হয়। তাবলীগ এক নিরলস সংগ্রাম ও সাধনার নাম। তাবলীগের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পরিচয় ও সম্পর্ক হওয়া, যাতে তার কাছ থেকে মানুষ সব সমস্যার সমাধান লাভ করে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি সফলতা পায়। এ কারণে এখানে দাওয়াতের পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণিত হচ্ছে। মূলত, মানুষ তিন প্রকার। দাওয়াতের পদ্ধতিও একইভাবে তিনটি।
দাওয়াতের প্রথম পদ্ধতি
যারা আলেম-ওলামা ও শিক্ষিত, তাদেরকে ‘হিকমতে’র মাধ্যমে-তাদের অবস্থা বুঝে, পরিস্থিতি বুঝে- দাওয়াত দিতে হবে। এ মুহূর্তে বলা যাবে কি না? তিনি এখন ব্যস্ত কি না? এসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে হলে সময় নিতে হবে। তিনি কোন ধরনের শিক্ষিত, মেজায কেমন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না আলেম। যদি আলেম হয়, তবে তাকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য আলেম ব্যক্তিকে পাঠাতে হবে। ডাক্তার হলে ডাক্তার পাঠাতে হবে। ইঞ্জিনিয়ার হলে ইঞ্জিনিয়ার পাঠাতে হবে। তার থেকে সময় নিতে হবে। কিছু হাদিয়া নিয়ে তার মেজায বুঝে অবসর সময়ে যেতে হবে। এসব হিকমত অবলম্বন করে দাওয়াত দিতে হবে। যদি কায়দা করে হিকমতের সাথে দাওয়াত দেওয়া যায়, তাহলে সহজে সে তার দাওয়াত গ্রহণ করবে।
আল্লাহ তা’আলা বড় সুন্দর কথা বলেছেন। হিকমত অবলম্বন করে দাওয়াত দেয়া জরুরী। অন্যথায় হিতে বিপরীত হতে পারে।
হযরত মাওলানা ইলিয়াছ (র.) এই হিকমতকে বেশি কাজে লাগিয়েছেন। এজন্য তাবলীগ জামাতের মধ্যে এই হিকমত বেশি ব্যবহার করতে দেখা যায়। ডাক্তারকে ডাক্তারের নিকট পাঠিয়ে দাওয়াত দেয়া হয়। ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠানো হয় ইঞ্জিনিয়ারের নিকট। এভাবে একজন আলেমের নিকট অন্য একজন আলেমকে পাঠানো হয়। অবসরপ্রাপ্ত বড় বড় অফিসার তাবলীগে আসে। তাদেরকে বড় বড় অফিসারদের নিকট দাওয়াত দিতে পাঠানো হয়। আর্মি অফিসারকে আর্মি অফিসারদের নিকট পাঠানো হয়। তারা যখন দাওয়াত দেয়, তখন তারা অতি সহজেই তা গ্রহণ করে এবং বলে ঠিকই তো, আমাদেরই তো অফিসার! আমাদেরই তো স্যার!
ডাক্তার এম আর খানের মত মানুষ যদি অন্য ডাক্তারকে দাওয়াত দেয়, তবে তাদের আর কোন প্রশ্নই থাকে না। সবাই সহজেই বুঝে যায়। একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার যদি অন্য ইঞ্জিনিয়ারকে দাওয়াত দেয়, তখন তার কথা তারা শুনতে বাধ্য। এজন্য আল্লাহ তা’আলা নবী (আ.)-কে শিক্ষা দিচ্ছেন যে, মানুষকে আল্লাহর পথে ‘হিকমতে’র মাধ্যমে ডাকুন।
মানুষের মেজায বুঝে হিকমতের সাথে দাওয়াত দেয়ার পদ্ধতিটা হযরত ইলিয়াছ (র.) পরিপূর্ণভাবে অবলম্বন করেছেন। দাওয়াত ও তাবলীগের অনেক পদ্ধতিই আছে, তবে ‘হিকমত’ এর পদ্ধতিটা তাবলীগী ভাইয়েরা বেশি অনুসরণ করে থাকেন। সব জায়গায় সবাইকে পাঠানো হয় না। আর সবসময়ও পাঠানো হয় না। যাদেরকে দাওয়াত দেয়া হবে, তাদের থেকে সময় নিয়ে, তার পরিস্থিতি বুঝে, মেজায বুঝে হিকমতের সাথে দাওয়াত দেওয়া হয়।
দাওয়াতের দ্বিতীয় পদ্ধতি
আল্লাহ তা’আলা দাওয়াতের দ্বিতীয় পদ্ধতি বলেছেন যে, যারা আওয়াম-জনসাধারণ, আলেম নয়, শিক্ষিত নয়, তাদেরকে সুন্দর সুন্দর ওয়াজের মাধ্যমে দাওয়াত দিতে হবে। ফযীলতের ওয়াজ করে দাওয়াত দিতে হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ওয়াজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দাওয়াত দিতে হবে। তাহলে তারা সহজে বুঝে যাবে।
সাধারণ জনগণ যেহেতু হ্যাঁছ-প্যাঁছ বোঝে না, সহজ সরল, তাদের জ্ঞান-বুদ্ধিও যেহেতু কম, এজন্য তাদেরকে একটু ফযীলতের কথা বললে তারা দ্রুত তা গ্রহণ করবে। যেমন বলা হল, হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন-
‘এক সকাল অথবা এক বিকাল যদি আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াতের কাজ করা যায়, মুজাহাদা করা যায়, তবে দুনিয়া এবং দুনিয়ার ভেতর যা কিছু আছে তার চেয়ে বেশি নেকী দান করবেন।’ (বুখারী শরীফ, পৃষ্ঠা-৩৯২)
এই হাদীসটি যদি শোনানো হয় এবং বলা হয় যে, দুনিয়াতে কোটি কোটি টাকার জিনিস আছে, এর সব কিছুই যদি আল্লাহর রাস্তায় দান করা হয়, তাহলে যে পরিমাণ নেকী হবে, এক সকাল অথবা এক বিকাল আল্লাহর রাস্তায় মেহনত করলে সেই পরিমাণ নেকী হবে। এত নেকীর কাজ! সঙ্গে সঙ্গে দাওয়াত গ্রহণ করবে।
এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটাও দাওয়াতে তাবলীগের মধ্যে পাওয়া যায়। তারাও এমন ফাযায়েলের কথা বয়ান করে করে সাধারণ লোকদেরকে দাওয়াত দিয়ে দিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসে। তারা মাসআলা-মাসায়েল বেশি বর্ণনা করতে যায় না। তাদের দাওয়াত শুধু ফাযায়েল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।
দাওয়াতের তৃতীয় পদ্ধতি
আল্লাহ তা’আলা দাওয়াতের তৃতীয় পদ্ধতি বলছেন, ঐ সমস্ত মানুষ যাদের মধ্যে কিছু সন্দেহ আছে, যারা একটু ত্যাড়া টাইপের মানুষ, উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করে, তাদের সঙ্গে একটু মুজাদালা করতে হবে। তর্ক করতে হবে। তবে শালীনতার মাধ্যমে তাদের সাথে তর্ক করতে হবে। লেখনীর মাধ্যমে উত্তর দিতে হবে। ঝগড়া-ঝাটি করা যাবে না। আর ঝগড়া-ঝাটি যদি বেঁধেই যায়, তাহলে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আর যদি ধৈর্য ধারণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে সে যেই পরিমাণ কথা বলবে, ঐ পরিমাণ বলতে পারবে। তার চেয়ে বেশি বলা যাবে না।
আল্লাহ তা’আলা ‘আহসান’ তথা সুন্দর পদ্ধতিতে তর্ক করার অনুমতি দিয়েছেন। শালীনতার মাধ্যমে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। চিল্লা-চিল্লি করা যাবে না। মারা-মারি করা যাবে না। এমন কোন সমস্যা যদি এসেই যায়, তাহলে সেটাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এভাবে আল্লাহর পথে ডাকতে হবে।
তাবলীগী ভাইদের আখলাক
তাবলীগী ভাইয়েরা কারো সঙ্গে ঝগড়া করে না, মারা-মারি করে না। কেউ উল্টা-পাল্টা বললে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে, উল্টা-পাল্টা প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। না মানলে ধৈর্য ধরে, ছবর করে। মসজিদে উঠতে না দিলে কোন ঝগড়া করে না। বুঝানোর চেষ্টা করে। যদি না বোঝে, বারান্দায় থাকে। বারান্দায়ও যদি থাকতে না দেয়, তাহলে সামনে যে ওযুখানা আছে, সেখানেই থাকে এবং মানুষকে দাওয়াত দেয়। মোটকথা আল্লাহ তা’আলা ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’র যে পদ্ধতিগুলো নবীয়ে কারীম (সা.)-কে বলেছেন, সে পদ্ধতিগুলো সামনে রেখেই তাবলীগী ভাইয়েরা মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়। যার কারণে দাওয়াতে তাবলীগের এই কাজটি দিন দিন কামিয়াবীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিছু কিছু বিপরীত দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, সবাই তো সমান নয়। তাই একক কোন ব্যক্তির অসঙ্গতি দেখে ভিন্ন মানসিকতা পোষণ করা ঠিক হবে না।
(দ্য রিপোর্ট/একেএম/জানুয়ারি ২৪, ২০১৪)