দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত
আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত টঙ্গীর তুরাগ তীর
মীর মোহাম্মদ ফারুক, গাজীপুর : টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে শুক্রবার মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় ধর্মীয় মহাসমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়েছে। লাখো মুসল্লির অংশগ্রহণে শুক্রবার দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে এ ইজতেমা ময়দানে।
বাদ ফজর পাকিস্তানি মাওলানা ইসমাইলের আমবয়ানের মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের দুই দফার প্রথম দফা বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। লাখো মুসল্লির আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত এখন শিল্প শহর টঙ্গী।
মূল মঞ্চ হতে সকাল থেকেই মাইকে বয়ান দেওয়া শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে তা বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা মাহমুদ। জুমার নামাজের পূর্ব পর্যন্ত বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন।
জুমার নামাজের ইমামতি করেন ঢাকার কাকরাইল মসজিদের খতিব মাওলানা যুবায়ের।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস-ট্রাক, ট্রেন ও লঞ্চযোগে লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে সমবেত হয়েছেন।
পুরো মাঠের ৪০ খিত্তায় জেলাওয়ারি তাবলিগ জামাতের মুসল্লিরা গত বুধবার থেকে অবস্থান নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত দলে দলে মুসল্লিদের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করতে দেখা যায়।
২৬ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে প্রথম পর্বের এ সমাবেশ। মাঝে চার দিন বিরতি দিয়ে ৩১ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দ্বিতীয় দফার বিশ্ব ইজতেমা।
সমাবেশে আগত মুসল্লিদের জন্য টঙ্গীর তুরাগ তীরে ১৬০ একর খোলা জমিনের ওপর পাটের চট দিয়ে সুবিশাল প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। তাবলিগ জামাতের এ মিলনমেলায় বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ১৩০টি দেশ থেকে ২০-২৫ লাখ মুসল্লির সমাবেশ ঘটেছে। প্রায় ৩০-৪০ হাজার বিদেশি মেহমানও যোগ দিয়েছেন ইজতেমায়।
বৃহস্পতিবার ইজতেমা ময়দানের সার্বিক প্রস্তুতিমূলক কাজ পরিদর্শন করেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুর সিটি মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান। এ সময় তাদের সঙ্গে তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বিরা উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত এই বিশ্ব ইজতেমা প্রথম ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগাড় নামক স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ঢাকার কাকরাইলে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৬৭ সাল থেকে নিয়মিত বর্তমান স্থানে বার্ষিক বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
শুক্রবার বাদ ফজর থেকে ময়দানে সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশে তাবলিগের ছয় উসুল সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনামূলক বয়ান শুরু হয়। ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানের মাওলানা ইসমাইলের আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাবলিগ জামাত আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব।
গাজীপুরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তফা জানান, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে এবার ইজতেমা মাঠে আরও একটি উৎপাদন নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এ নলকূপ ছাড়াও ইজতেমা ময়দানে সচল আরও ১১টি উৎপাদন নলকূপ বা মোট ১২টি নলকূপ থেকে প্রতিদিন একটানা ২২ ঘণ্টায় এক লাখ গ্যালন পানি সরবরাহ করা যাবে।
এ ছাড়াও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এবং ওয়াসা ইজতেমা এলাকায় পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে।
বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা : র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান জানান, এবার র্যাব সদস্যের সংখ্যা গতবারের চেয়েও বেশি থাকবে। ৫ স্তরে পুরো ইজতেমা এলাকা ও আশপাশে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন তারা। দুই পর্বের ইজতেমার মূল ছয় দিন র্যাবের হেলিকপ্টার টহল দেবে।
খিত্তায় খিত্তায় সাদা পোশাকে র্যাব সদস্যরা অবস্থান করবেন। থাকবে র্যাবের কন্ট্রোল রুম ও পেট্রোল ডিউটি। ইজতেমা মাঠের প্রবেশপথে ও আশপাশে ৬০টি সিসি টিভি ক্যামেরায় সার্বিক কার্যক্রমের চিত্র ধারণ করা হচ্ছে। ইজতেমা শুরুর দিন থেকেই ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকায় হেলিকপ্টার টহল দেবে। তুরাগ নদীতে নৌ-টহল দল কাজ শুরু করেছে।
মাঠে প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে দেহ তল্লাশি, মাঠের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে স্থাপিত অস্থায়ী টাওয়ার থেকে র্যাব ও পুলিশ সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান জানান, ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য র্যাব, পুলিশসহ এবার প্রায় ১০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী কাজ করছে। ইজতেমা মাঠের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে র্যাবের নয়টি ও পুলিশের জন্য পাঁচটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা : স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক ডা. সিফায়েত উল্লাহ বলেন, ইজতেমা উপলক্ষে সব প্রস্তুতি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে আরও ৫০টি শয্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। হাসপাতালে একটি নিজস্ব কন্ট্রোল রুম ছাড়াও কার্ডিয়াক, বার্ন, অ্যাজমা, ট্রমাসহ বিভিন্ন ইউনিট খোলা হয়েছে।
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন : বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে মন্নু টেক্সটাইল মিলের মাঠে হামদর্দ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। হামদর্দ বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক ডা এম. আর খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, ওয়াকফ প্রশাসক বজলুল হক বিশ্বাস, র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের (ওয়াকফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিফ মোতয়াল্লি ড. হাকিম মো. ইউসুফ হারুন ভূঁইয়া, হামদর্দ ফাউন্ডেশনের পরিচালক লে. কর্নেল মাহবুবুল আলম চৌধুরী (অব.) প্রমুখ।
এ ছাড়াও ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প এলাকায় জনকল্যাণ ফার্মা, রেনাটা, বিএমএ, র্যাব, টঙ্গী পৌরসভা, টঙ্গী থানা প্রেস ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইসলামী ফাউন্ডেশন, ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট, যমুনা ব্যাংক, এপেক্স বাংলাদেশ, কিউআইএস মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনসহ প্রায় ৪০টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করেছে।
মৃত্যুবরণ : গতকাল গভীর রাতে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার উত্তর রামেরকান্দা গ্রামের মো. ওমর আলী (৪৮) ইজতেমা ময়দানে এসে বুকে ব্যথা অনুভব করলে হাসপাতালে নেওয়া হয়। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার মধ্য সেতোয়ালী গ্রামের আব্দুল মজিদ প্রামাণিক (৬৫) নামে এক মুসল্লি অসুস্থ হয়ে মারা যান। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মাহবুবুর রহমান সংবাদটি নিশ্চিত করে জানান, উভয়কে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।
বিদেশি মেহমান : প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে শতাধিক দেশের বিদেশি মুসল্লি আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে টঙ্গীর ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরব্বি ও বিদেশি মেহমানদের তাঁবুর জিম্মাদার প্রকৌশলী মো. মুহিবুল্লাহর সঙ্গে কথা বললে তিনি আগত বিদেশি মুসল্লির সঠিক সংখ্যা জানাতে না পারলেও বিশ্বের অন্তত শতাধিক দেশের প্রায় ২০-২২ হাজার বিদেশি মেহমান এবারের ইজতেমা ময়দানে অংশগ্রহণ করবেন বলে জানান। এবার যে সব দেশের মুসল্লিরা ইজতেমায় যোগ দিচ্ছেন সেগুলো হচ্ছে- পাকিস্তান, ভারত, কাতার, দুবাই, ইরান, ব্রুনাই, নিউজিল্যান্ড, কলম্বিয়া, মালয়, মরিসাস, হল্যান্ড, ফিজি, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, ফান্স, জার্মান, কেনিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, ইউকে, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিপিন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মালে, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, চীন, তুরস্ক, ফিলিস্তিন, যুক্তরাজ্য, জাম্বিয়া, শ্রীলংকা, রাশিয়া, চিলি, কম্বোডিয়া, ভেনিজুয়েলা, তিউনেশিয়া, ইতালি, সুইডেন, সৌদি আরব, জর্ডান, ওমান, আলজেরিয়া, সোমালিয়া, লেবানন, ইথিওপিয়া, মৌরিতানিয়া, জিবুতি, সুদান, মরক্কো, ইয়েমেন, ডেনমার্ক, সিরিয়া, চাঁদ, মিয়ানমার, ইংল্যান্ড, ইরাক, মিশর, নরওয়ে, মাদাগাস্কার, নাইজেরিয়া, পানামা, সেনেগাল, তানজানিয়া, ত্রিনিদাদ, ক্যামেরুন, কমোরস, কোরিয়া, বাহরাইন, ইরিত্রিয়া প্রভৃতি।
ভ্রাম্যমাণ আদালত : গাজীপুর ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলাম মজুমদার বলেন, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গী ও আশপাশ এলাকায় ১২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টঙ্গীর বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা করে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে খাদ্যদ্রব্য ও মাদকদ্রব্য আইনে ৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ভাসমান সেতু : ইজতেমা পন্টুন ব্রিজ (ভাসমান সেতু) স্থাপন কাজের তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর মো. এমরান ইসলাম ভূঁইয়া জানান, মুসল্লিদের নদী পারাপারের সুবিধার্থে ইজতেমা ময়দানের সঙ্গে টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কের সংযোগ স্থাপনের জন্য তুরাগ নদীর উপর ৮টি পন্টুন সেতু স্থাপন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা এ সেতুগুলো স্থাপন করছে।
খিত্তা : এবারের বিশ্ব ইজতেমায় প্রথম পর্বে দেশের ৩২ জেলার মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করবেন। এ উপলক্ষে পুরো ইজতেমা ময়দানকে ৪০টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। খিত্তা নম্বরসহ জেলাগুলো হচ্ছে- গাজীপুর (১-২), ঢাকা (৩-১২), সিরাজগঞ্জ (১৩), ফরিদপুর (১৪), নরসিংদী (১৫), কিশোরগঞ্জ (১৬), রাজবাড়ী (১৭), শরিয়তপুর (১৮), নাটোর (১৯), শেরপুর (২০), দিনাজপুর (২১), হবিগঞ্জ (২২), রংপুর (২৩), লালমনিরহাট (২৪), গাইবান্ধা (২৫), জয়পুরহাট (২৬), রাজশাহী (২৭), সিলেট (২৮), চাঁদপুর (২৯), ফেনী (৩০), চট্টগ্রাম (৩১), বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি (৩২), বাগেরহাট (৩৩), কুষ্টিয়া (৩৪), নড়াইল (৩৫), চুয়াডাঙ্গা (৩৬), যশোর (৩৭), ভোলা (৩৮), বরগুনা (৩৯) ও ঝালকাঠি (৪০)।
বিশেষ বাস ও ট্রেন সার্ভিস : ইজতেমায় মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থায় ২১টি ট্রেন ও ৩০০ বিআরটিসির বাস চলাচল করবে। এ বিষয়ে টঙ্গী রেল জংশনের স্টেশন মাস্টার হালিমুজ্জামান বলেন, ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে ২৪ জানুয়ারি হতে জামালপুর থেকে টঙ্গী এবং আখাউড়া থেকে টঙ্গী দুটি ট্রেন চলাচল করছে। তবে আখেরি মোনাজাতের দিন ২১টি ট্রেন থাকবে, এমনকি প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেন টঙ্গী রেল জংশনে থামবে।
(দ্য রিপোর্ট/এএস/এএস/এএল/জানুয়ারি ২৪, ২০১৪)